রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান কিংবা দলীয় সভা—বঙ্গবন্ধু যেখানেই যেতেন না কেন, খন্দকার মোশতাক ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর সেখানেই উপস্থিত থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের ‘আনুগত্য’ ছিল দৃশ্যমান, কখনও কখনও দৃষ্টিকটুও। অথচ এই তাহের উদ্দিন ঠাকুর ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ষড়যন্ত্রে খন্দকার মোশতাকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। প্রত্যক্ষদর্শী ও গবেষকরা বলছেন, খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর সামনে থাকলে অনুমতি না নিয়ে পানিও পান করতেন না। মোশতাক ও ঠাকুরকে মোটামুটি সবসময় একসঙ্গেই দেখা যেতো। এত তোষামোদি ও ছদ্মবেশের পরেও বঙ্গবন্ধু স্বয়ং তাদের ষড়যন্ত্র টের পেয়েছিলেন।
খন্দকার মোশতাক ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরের তোষামোদির উদাহরণ দিতে গিয়ে ২০১৬ সালে শোক দিবসের এক সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘১৯৭৫ সালের ১ আগস্ট। মাগরিবের নামাজের সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে দেখা করতে যান আমার পিতা। সেখানে আগে থেকে বসা ছিলেন খন্দকার মোশতাক ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর। পিতা যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পাশের কক্ষে গেলেন। বঙ্গবন্ধু উঠে যাওয়ার পরপরই আমার বাবাকে মোশতাক ‘বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে একটু নামাজ পড়ার অনুমতি নিয়ে দিতে বলেন।’ তখন আমার পিতা মোশতাককে বলেন, ‘নামাজ পড়ার জন্য অনুমতি নেওয়ার কি দরকার আছে। আপনারা যদি নামাজ পড়বেন তাহলে আপনারাই অনুমতি চান না কেন?’ পরে বঙ্গবন্ধু আসার পর মোশতাকদের নামাজ পড়ার জন্য যেতে বললেন।’’
এই দুই জনের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ধারণা কেমন ছিল বলতে গিয়ে আনিসুল হক আরও বলেন, ‘তারা দুজন নামাজ পড়তে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ও আমার পিতা কথা বলতে শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধু আমার পিতাকে বললেন—সুনির্দিষ্ট খবর আছে যে খন্দকার মোশতাক আমার পিতাকে মেরে ফেলবে। আমার আব্বা হজম করে নিয়ে বললেন, যদি এরকম খবর থাকে তাহলে আমাকে (আইনমন্ত্রীর বাবা) না, তোমাকে (বঙ্গবন্ধু) মারবে? তার কারণ হচ্ছে, আমাকে মারলে তার একটা বুলেটেরও দাম উঠবে না। তোমাকে মারবে। উনি (বঙ্গবন্ধু) তখন বলেছিলেন, খন্দকার মোশতাকের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত হারামিতে ভরা। ওকে বাংলাদেশের কেউ চেনে না, আমি ছাড়া।’
১৯৭৫ সালের ৬ আগস্ট। ‘বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ গঠন করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ৭ লাখ টাকার একটি চেক তুলে দিয়েছিলেন তখনকার তথ্য ও বেতারমন্ত্রী এম কোরবান আলী। চেক হাতে পেয়েই বঙ্গবন্ধু সেটি শ্রম, সমাজকল্যাণ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীর কাছে হস্তান্তর করেন। পরের দিনের পত্রিকার প্রথম পাতায় সেই ছবি ছাপা হয়। সেখানেও বঙ্গবন্ধু এবং উল্লিখিত দুই মন্ত্রীর সঙ্গে মুজিব কোট পরা তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে দেখা যায়।
২০ জুলাই ১৯৭৫। কুমিল্লায় খন্দকার মোশতাক আহমেদ বলেন, ‘নয়া প্রশাসনিক ব্যবস্থায় গণপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মচারীদের সমভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোগের সৃষ্টি হবে।’ তিনি সেখানে বঙ্গবন্ধুর নয়া বিপ্লবের বেশ সুনাম করেন। তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের সঙ্গে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছেন।’ কোথাও কেউ বঙ্গবন্ধুর কাজের সমালোচনা দূরে থাক, পুরো সময় তারা তোষামোদি করে কাটিয়েছেন।
খন্দকার মোশতাক ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরের এমন তোষামোদির উদাহরণ দিতে গিয়ে সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখক হারুন হাবীব বলেন, ‘তখন সবে বাসসে ঢুকেছি। খন্দকার মোশতাককে তখন দেখেছি বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে। বেশিরভাগ সময় তার সঙ্গে থাকতেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্টের ঘটনা। সিকান্দার আবু জাফর সেদিন মারা গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা কাভার করতে গিয়ে দেখি—খন্দকার মোশতাক ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর বিমর্ষ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। তারা সেদিন গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি। কুমিল্লা সেনানিবাসে (নবীন অফিসারদের) প্রথম পাসিং আউটের দিনের কথা মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে করে যখন সেখানে পৌঁছালেন, এই দুই জন দৌড়ে গেলো এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো, মোশতাক চুমু খেলো। কয়দিন পরেই সেই মোশতাককে ভিন্ন চেহারায় দেখি। ১৫ আগস্ট অফিসে গিয়ে রাস্তায় পুলিশের হুইসেল শুনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি—মোশতাক হাত নেড়ে নেড়ে রেডিও’র দিক থেকে ফিরছে। এরপর তো সে বঙ্গভবনে চলে গেলো। পরে আর তাকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়নি।’