একটি স্লোগান অনলাইনে আলোড়ন তুলেছে— ‘আমরা ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় দেখতে চাই’। এর পেছনের রহস্য খুজতে অনুসন্ধান চালিয়েছে ডিসমিস ল্যাব। বুধবার (২৮ মে) ডিসমিস ল্যাব তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, এই স্লোগান এখন রাজনীতির বাইরেও ফেসবুকে খাবার, প্রসাধনী, পোশাক কিংবা ব্যক্তিগত ভ্লগের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হচ্ছে শুধুমাত্র লাইক বা ফলো বাড়াতে।
ডিসমিস ল্যাব তাদের প্রতিবেদনে জানায়, গত কয়েক মাস ধরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক মহল, মূলধারার মিডিয়া এবং সামাজিক প্ল্যাটফর্মে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নিয়োগ পাওয়া ড. ইউনূস ধারাবাহিকভাবে বলে আসছেন যে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তারপরও তার মেয়াদ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। বিশেষ করে একটি স্লোগান অনলাইনে আলোড়ন তুলেছে— ‘আমরা ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় দেখতে চাই।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে যা শুরু হয়েছিল তা হঠাৎ একটি অপ্রত্যাশিত প্রেক্ষাপটে উপস্থিত হয়েছে। এই রাজনৈতিক স্লোগান ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক বিজ্ঞাপনও। তবে তা কোনও রাজনৈতিক সংগঠন থেকে নয়, বরং খাবার, প্রসাধনী, পোশাক এবং ব্যক্তিগত ভ্লগের ফেসবুক পেজ থেকে প্রচারিত হচ্ছে। এসব বিজ্ঞাপনে ড. ইউনূসের নাম ও ছবি ব্যবহার করা হয়ে আসছে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, প্রায়ই পেজটিকে ‘লাইক’ বা ‘ফলো’ করার আহ্বান জানানো হতো। ডিসমিস ল্যাব তাদের অনুসন্ধানে দেখেছে, এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্তত ৪৭টি ফেসবুক পেজে এ ধরনের ৫৫টি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।
ডিসমিস ল্যাব জানায়, তাদের গবেষকরা বাংলা ভাষার কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করে মেটার অ্যাড লাইব্রেরি থেকে বিজ্ঞাপনগুলোর তথ্য পুনরুদ্ধার করেন। তারপর তাদের স্বাভাবিক কার্যকলাপ বোঝার জন্য প্রতিটি পেজের সাম্প্রতিক ২০টি পোস্ট পর্যালোচনা করেন। এসব বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে প্রায় ৯০ শতাংশই রাজনৈতিক বিষয়ে কোনও পোস্ট করেনি।
খাবার বিক্রি থেকে ভ্লগ, স্লোগান যেভাবে ছড়িয়ে গেলো
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় দেখতে চাই’ স্লোগানটি ছড়িয়ে পড়ে। সদ্য গঠিত এনসিপি নেতা সারজিস আলম একটি ফেসবুক পোস্টে স্লোগানটি ব্যবহার করেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চলমান আলোচনা ও অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে— এই দাবি সামনে আসে এবং তাৎক্ষণিকভাবে নানা রাজনৈতিক দলের নেতারা এটিকে অবাস্তব ও অগণতান্ত্রিক বলে সমালোচনা করেন। বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর ডিসমিস ল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা যায়– কিছু ফেসবুক পেজ এই জনমতের সুযোগ নিয়ে নিজেদের পেজে এমন বিজ্ঞাপন চালানো শুরু করে। ১৫ থেকে ১৭ মে’র মধ্যে ‘ইউনূস’, ‘ইউনুস (বিকল্প বানান) এবং ‘৫ বছর’– এই তিনটি বাংলা কি-ওয়ার্ড দিয়ে মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে সার্চ দিয়ে এমন ৫৫টি বিজ্ঞাপন শনাক্ত করা হয়, যেগুলো ৪৭টি আলাদা ফেসবুক পেজ থেকে চালানো হয়েছে। প্রতিটি পেজের সবশেষ ২০টি পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ পেজ এর আগে কখনও কোনও রাজনৈতিক পোস্ট দেয়নি। তাদের নিয়মিত কার্যক্রমে এমন ধরনের স্লোগান একেবারেই ব্যতিক্রম।
ঢাকাভিত্তিক রেস্টুরেন্ট পেজ ‘দ্য টেস্টি অ্যাপ্রন’ ১৩ ও ১৪ মে দুটি বিজ্ঞাপন চালায়। একটি বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, ‘আপনি যদি চান ড. ইউনূস পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক, তাহলে ডান পাশে লাইক অপশনে ক্লিক করুন।’ বিজ্ঞাপনের নিচে ডান পাশে একটি ‘লাইক’ বাটন দেখা যায়। ১৮ মে পর্যন্ত তাদের সবশেষ ২০টি পোস্টের কোনোটিতেই রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ছিল না।
যেসব পেজ আগে থেকেই কিছু রাজনৈতিক পোস্ট দিয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ‘মোটিভ ডিজিটাল’ ও ‘মি. ইসমাইল’। এই দুটি পেজের বিজ্ঞাপন পরে মেটা সরিয়ে নেয়। মোটিভ ডিজিটাল ৬ মে একটি পোস্টে লেখে: ‘নেতৃত্বে পরিবর্তন মানেই ভবিষ্যতের পরিবর্তন।’ অপরদিকে মি. ইসমাইল একটি বিজ্ঞাপনে ড. ইউনূসের নামাজরত একটি ছবি দিয়ে লেখে, ‘উন্নয়ন না নির্বাচন?’
৪৭টি পেজের মধ্যে ৩০টি অর্থাৎ প্রায় ৬৪ শতাংশ, বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে খাবার, প্রসাধনী, পোশাক, স্বাস্থ্যসেবা ও মৌসুমি ফল। ৮টি ছিল ব্যক্তিগত বা ভ্লগ ধরনের পেজ, আর দুটি নিজেদের মিডিয়া আউটলেট হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। বাকি পেজগুলো ‘পাবলিক ফিগার’ বা ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ হিসেবে তালিকাভুক্ত।
রাজনৈতিক স্লোগানে লাইকের ফলন
ডিসমিস ল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ৪৭টি ফেসবুক পেজে গড়ে প্রতি পেজে ৩৫ হাজারের বেশি লাইক এবং ৩৭ হাজারের বেশি ফলোয়ার ছিল। পুরনো ও নতুন– দুই ধরনের পেজই এই রাজনৈতিক স্লোগান ব্যবহার করেছে নিজেদের লাইক ও জনপ্রিয়তা বাড়ানোর কৌশল হিসেবে।
সবচেয়ে বেশি লাইক পাওয়া যায় ‘খবর২৪’ নামের একটি সংবাদ পেজে, যার ফলোয়ারের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৪৩ হাজার। পেজটি নিয়মিত ফটো কার্ড পোস্ট করে এবং মন্তব্যের ঘরে বার্তা টাইমস২৪– এর লিংক শেয়ার করে। বিপরীতে সবচেয়ে কম লাইক রয়েছে প্রিমিয়াম বিডি নামের একটি পেজ, যার ফলোয়ার মাত্র ১১ জন। নতুন এই পেজটি ইউটিউব প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন বিক্রি করে। এদের মধ্যে ২৬টি পেজের অ্যাডমিনদের লোকেশন পাওয়া গেছে। ২৪টি পেজ পরিচালিত হয় বাংলাদেশ থেকে, একটি পরিচালিত হয় ইতালি থেকে এবং একটি পেজ যৌথভাবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
নতুন মোড়কে পুরনো কৌশল
ফেসবুক বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে এমন কৌশল নতুন নয়। ডিসমিস ল্যাবের আগের অনুসন্ধানেও এ ধরনের বিজ্ঞাপন চালানোর নজির পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও অন্য দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করে। এর আগে ২০২৩ সালে জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে একটি পেজ একটি বিজ্ঞাপন চালায়, যেখানে লেখা হয়, ‘ভোট চলছে– খালেদা জিয়াকে জিতিয়ে দিতে চাইলে ডান পাশে লাইক দিন।’ ২০২৪ সালে আরেকটি বিজ্ঞাপন ছাড়া হয়, যেখানে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পাশাপাশি ছবি দিয়ে লেখা হয়, ‘খালেদা জিয়াকে জিতিয়ে দিতে চাইলে ডান পাশে লাইক করুন।’ যদিও বিজ্ঞাপনটি একটি ব্যবসায়িক পেজ থেকে ছাড়া হয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিক চিত্র ব্যবহার করে মানুষের মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
ডিসমিস ল্যাব জানিয়েছে, এই অনুসন্ধানটি ২০২৫ সালের ১৫ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত চালানো হয়েছে। গবেষকরা মেটার অ্যাড লাইব্রেরি ব্যবহার করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বাংলাভাষার ফেসবুক বিজ্ঞাপনগুলো চিহ্নিত করেন। এই অনুসন্ধানে ৫৫টি বিজ্ঞাপন চিহ্নিত হয়, যা ৪৭টি আলাদা ফেসবুক পেজ থেকে চালানো হয়েছিল এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে। প্রতিটি পেজ চিহ্নিত হওয়ার পর, গবেষকেরা তাদের সবশেষ ২০টি পাবলিক পোস্ট পর্যালোচনা করেন, যাতে বোঝা যায়— পেজটি পূর্বে কোনও রাজনৈতিক কনটেন্ট শেয়ার করেছে কিনা।
বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণের পাশাপাশি, ডিসমিস ল্যাব ছয় জন পেজ অ্যাডমিনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে জানতে চায়— কেন তারা এ ধরনের বিজ্ঞাপন চালিয়েছেন এবং কী ধরনের বিজ্ঞাপন কৌশল ব্যবহার করেছেন। যেসব পেজের নাম বা অ্যাডমিনের বক্তব্য আগে থেকেই প্রচারিত বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত, শুধু সেই তথ্যগুলো প্রকাশ করা হয়েছে, আর অন্যদের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। এসব অনুসন্ধানকে মেটার প্রচলিত বিজ্ঞাপন নীতিমালা এবং পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে আলোচিত নজরদারি প্রবণতার সঙ্গে তুলনা করে প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে।