X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

পাঠ্য বইয়ে ভাইভার, স্কাইপকে ‘সেক্স ক্যামেরা’ আখ্যা!

রশিদ আল রুহানী
২০ মে ২০১৬, ১৪:২৮আপডেট : ২০ মে ২০১৬, ১৯:০৩

ব্যবস্থাপনা বই

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ‘রিটেইল ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়। এই কোর্সটি পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে রয়েছে রেনেসাঁ বুক ডিপো থেকে প্রকাশিত একটি বই। বইটির শেষ অধ্যায়ের একটি নিবন্ধ হচ্ছে, ‘একবিংশ শতাব্দীর জীবন ধাঁচসমূহ’। এই রচনায় একবিংশ শতাব্দীর তথ্য প্রযুক্তি উন্নয়ন সম্পর্কে লেখকরা তাদের নিজস্ব মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে খুবই ‘নোংরাভাবে’ সমালোচনা করেছেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। যোগাযোগের সুবিধায় ব্যবহৃত জনপ্রিয় ভিডিও অ্যাপস (সফটওয়্যার) গুলোকে ‘সেক্স ক্যামেরা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বর্তমানে স্টার জলসা, জি-টিভি এমনকি ‘সেলফি’ মেয়েদের ওপর অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে একবিংশ শতাব্দী সম্পর্কে এমন উপস্থাপন ‘উচিত হয়নি’ বলে অকপটে স্বীকারও করেছেন।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্য বইয়ের সামান্য ভুল চোখে পড়লেই সেটা ‘মারাত্মক ভুল’ মনে করে সবার কাছে স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যে কতো ভুল পড়ছেন, ভুল শিখছেন সেদিকে খেয়াল করছেন না কেউ, যা অনেক বেশি হতাশাজনক বলে মন্তব্য শিক্ষাবিদদের। তারা বলছেন, কেবল ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে বলেই হযবরলভাবে বই প্রকাশ করেন লেখকরা। গুণগত মানের দিকে কোনও খেয়াল নেই তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বইটির বিকল্প কোনও বই নেই বাংলাদেশে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস প্রণেতারা দেশের বাইরের এক লেখকের বইয়ের রেফারেন্স দিলেও দেশের কোথাও বইটি পাওয়া যায়না। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ছেন বেসরকারি চার কলেজ শিক্ষকের রচনায় প্রকাশিত ‘খুচরা বিক্রয় ব্যবস্থাপনা’ বইটি।

রাজধানীর ইডেন কলেজের মার্কেটিং বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘এই বইটিতে একবিংশ শতাব্দী নিয়ে যে ধরনের সমালোচনা করা হয়েছে, তা আসলেই হতাশাজনক। কলেজ শিক্ষকরাই যদি একবিংশ শতাব্দী নিয়ে এ ধরনের ‘নোংরা’ মন্তব্য করেন তাহলে আমরা যারা এসব বই পড়ছি, তারা কী শিখবো? তারপরও সেটাই আমরা পড়ছি, শিখছি এবং পরীক্ষার খাতায় লিখে পাশ করছি।’

বইটি ঘেটে দেখা যায়, ইন্টারনেট কি? এটা বোঝাতে গিয়ে শুরুতেই লেখক বলেছেন, ‘আলু ভর্তা থেকে শুরু করে ঝোলসহ আলুদম, পনির থেকে শুরু করে ফ্রেন্সফ্রাই, মুরগী ভুনা থেকে শুরু করে মাছ ভাজা খাওয়ার মতো ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার মানুষের হাতে হাতে ব্যবহার হচ্ছে।’

‘রিয়েলিটি টিভি’ সম্পর্কে বর্ণনার এক পর্যায়ে লেখক বলেছেন, “ভারতের স্টার-জলসা এবং জি বাংলা টিভি চ্যানেল আমাদের দেশের মেয়েদের ওপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। ভারতের ‘পাখি’ নামক পোশাকের কারণে আমাদের দেশে  অনেকে আত্মহত্যা করেছে।” এ অংশের সমালোচনা করে শিক্ষাবিদরা বলছেন, ‘এইসব চ্যানেল শুধুমাত্র মেয়েদের ওপর প্রভাব ফেলছে কীভাবে? মেয়েরা যদি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েই থাকে, তার বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা কি আছে? থাকলে তার উল্লেখ কোথায়?’

সেলফির বর্ণনা করতে গিয়ে এখানে বলা হয়েছে, ‘একবিংশ শতাব্দীর জীবন ধাঁচে সেলফি যুক্ত হয়েছে। নিজেই নিজের ছবি তুলে যুবক-যুবতীরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছেন। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে সেলফি তোলার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ সেলফি মেয়েদের ওপরেই বিশেষ  প্রভাব ফেলেছে এই কথাটির প্রমাণ কী, তা জানতে চান শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবিদরা।

পর্নোগ্রাফির বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘নামী-দামী সেলেব্রেটিগণ যত কম কাপড় পরে তাদের ছবি প্রকাশ করতে পারছেন, ততই তারা সমাজে উজ্জ্বল হচ্ছেন। আগে তো ফিল্ম স্টারদের নাম শোনা যেত, আর বর্তমানে পর্নো স্টার নামে সানি লিওনের মত মেয়েও বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। বিভিন্ন ওয়েব সাইটগুলোতে নগ্ন ছবি ও ভিডিও চিত্র বিনা বাধায় প্রকাশ পাচ্ছে। পর্নো যেন আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে নগ্নতাই যদি সভ্যতা হতো, তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য জাতি প্রাণিরাই হতো।’ সানি লিওনের বিখ্যাত হওয়ার খবর লেখক কীভাবে জানেন, প্রশ্ন রয়েছে শিক্ষার্থীদের।

লাইভ ক্যাম-এর বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ‘জীবন্ত ক্যামেরা’। যদিও এই ‘লাইভ’ অর্থ সরাসরি। লাইভ ক্যাম-এর বর্ণনায় লেখক বলেছেন, ‘স্কাইপ, ভাইভার, হোয়াটস অ্যাপ -এর মতো ভিডিও কনফারেন্সিং ওয়েবসাইট চালিয়ে পৃথিবীর সকল মানুষকে জীবন্ত ক্যামেরা উপহার দিচ্ছে’। এখানে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে জীবন্ত সেক্স ক্যামেরাও চালু করছে, যেখানে মানুষ একে অন্যের নগ্নতা সরাসরি উপভোগ করে নিজের জীবনকে নরকের অতল গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। আর এ অবস্থা দেখে অনেক পিতামাতা কেঁদে ফেলেন। হায়রে একবিংশ শতাব্দীর জীবন ধাঁচ।’

একবিংশ শতাব্দী সম্পর্কে এমন নিম্নমানের যুক্তিহীন উপস্থাপনকে কট্টর সমালোচনা করেছেন শিক্ষাবিদ, গবেষক ও শিক্ষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দী তো মাত্র শুরু। কিন্তু একটি পাঠ্য বইয়ে পুরো এই শতক নিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া একটা লেখা নিজের দৃষ্টভঙ্গি দিয়ে লিখলেই তো হবেনা। তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা তো থাকতে হবে।’

লেখকরা যে বলেছেন, ‘সন্তানদের এমন নগ্নতা দেখে পিতা মাতা কেঁদে ফেলেন। হয়তো কাঁদেন কিন্তু সেই পিতামাতা কারা, তারা কোন শ্রেণি পেশার মানুষ, তারা কতো শতাংশ। এছাড়া ‘হায়রে একবিংশ শতাব্দীর জীবন ধাঁচ’ এই কথাটার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, লেখক তার নিজের দুঃখ বইটিতে প্রকাশ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ে যদি এমন নিম্নমানের যুক্তিহীন এবং লেখকের ব্যক্তিগত মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বই প্রকাশ করেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা তো ভুল পথে পরিচালিত হবে বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।

এদিকে রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের মার্কেটিং বিভাগের প্রধান আব্দুল কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা থাকে নির্ধারিত বই ছাড়া সহায়ক যেকোনও বই পড়া যাবে। কিন্তু নির্ধারিত ইংরেজি ভার্সনের বইটি দেশে পাওয়া যায়না। তাই এই বইটি শিক্ষার্থীদেরকে বাধ্য হয়ে পড়তে হয়।’

বইটিতে অনেক ভুল তথ্য আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘উপায় নেই, এটা ছাড়া বাজারে বিকল্প কোনও বই নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমাদেরকে এই বইটিই পড়াতে হয়।’

বইটি লিখেছেন চার জন লেখক। তারা কেউ সরকারি কলেজের শিক্ষক নন। অথচ তাদের লেখা বই সরকারি বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ছেন। খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিম, যিনি হাবীবুল্লাহ বাহার ইউনিভার্সিটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক, এস. এম. রকিবউজ্জামান, যিনি মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, মো. মনোয়ারুল কবির, তিনি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মো. আবুল কালাম আজাদ, তিনি সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক। তবে মজার ব্যাপার হলো, বইটির সম্পাদনায় কেউ ছিলেন না।

খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিমের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি নিজেই তাদের বইয়ের লেখা পড়ে একটা হাসি দিয়ে অকপটে ভুল স্বীকার বলেন, ‘কিছুই করার নেই। এই কোর্সটি পড়ানোর জন্য এই বইটি ছাড়া বিকল্প কোনও বই বাজারে পাওয়া যায়না। আমরা চার জন লেখক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুসরণ করে বইটি প্রকাশ করেছি। তবে একবিংশ শতাব্দী নিয়ে যে বর্ণনা করা হয়েছে, তা ইন্টারনেট থেকে একটি ইংরেজি আর্টিকেল ডাউনলোড করে অনুবাদ করেছি।’

তার কথা শুনে ইন্টারনেটে আর্টিকেলটি খুঁজে পাওয়া গেলো। কিন্তু আর্টিকেলটিতে কোনও লেখকের নাম নেই। নর্থ আমেরিকার একটি ব্লগে এই লেখাটি প্রকাশ হয় ২০১৩ সালে। আর্টিকেলটি পড়ে দেখা গেলো ওই আর্টিকেলের সঙ্গে  এই বইয়ে প্রকাশিত লেখাটির প্রায় ৭০ শতাংশ অমিল রয়েছে।

এ বিষয়ে মুস্তাকিম বলেন, ‘জানি অনেক ভুল আছে বইটিতে। ইংরেজি আর্টিকেল থেকে অনুবাদ করেছি ঠিকই, কিন্তু আমাদের সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু কথা উপস্থাপন করেছি। হয়ত সেটাই ঠিক হয়নি। তবে আপনার মতো করে যদি কেউ এমন ভুল ধরিয়ে দিতো, তাহলে বইটি আবারও সংস্করণ করতাম।’ বইটির কোনও সম্পাদক নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রেনেসাঁ বুক ডিপোই এই বইটির সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছিল।’

রেনেসাঁ বুক ডিপোর প্রকাশক কৃষ্ণ দুলাল ঘোষও বইটিতে ভুল আছে স্বীকার করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খুব অল্প সময়ে আমরা বইটি বাজারে আনায় কিছু ভুল থেকে গেছে। ২০১৫ সালের শুরুতে বইটি বাজারে আনা হয়। তবে ২০১৬ সালে আমরা আর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করিনি। কারণ, একবার বই প্রকাশ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা পুরাতন বই দিয়েই পড়েন। নতুন বইয়ের আর চাহিদা থাকেনা।’ এই প্রতিবেদককে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি যেহেতু বলেছেন আপনাকে ধন্যবাদ। যদি সম্ভব হয় একবিংশ শতাব্দী সম্পর্কে পরবর্তীতে আরও ভালো গবেষণা করে তবেই আমরা বই প্রকাশ করবো।’

আরও পড়ুন: আনসারুল্লাহ'র ছয় সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

আরও পড়ুন: বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনে ‘কর’ বিষয়ক জটিলতার আশঙ্কা

/আরএআর/এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ