দেশের সব শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসার লক্ষ্যে প্রতি বছরের শুরুতে তাদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেয় সরকার। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত ১ জানুয়ারি রীতিমতো বই উৎসব করে শিশুদের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সপ্তাহ না গড়াতেই বিনামূল্যের বই চলে এসেছে বাজারে! এসব বই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটে।
গত ৩১ ডিসেম্বর বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে পাঠ্যপুস্তক উৎসবের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। অনুষ্ঠানে তিনি জানান, এবছর ৪ কোটি ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।
অথচ সে সব ‘বিনামূল্যের বই’ এখন বিক্রি হচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যায় বাকুশাহ মার্কেটের ‘নিউ বুক ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি দোকানে বিনামূল্যের বইয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে। ক্রেতা সেজে এই প্রতিবেদক নতুন বই চাইলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব পাঠ্যপুস্তক বের করে দেন এক বিক্রেতা।
তিনি জানান, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির এক সেট বইয়ের দাম ৯০০ টাকা। আর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির এক সেট বইয়ের দাম ২ হাজার টাকা। তাদের কাছে গত বছরের বইও আছে বলে জানালেন।
বিনামূল্যের এসব বই কোথায় পেয়েছেন জানতে চাইলে ‘নিউ বুক ওয়ার্ল্ড’ এর বিক্রেতা সাহাদাত হোসেন রানা জানান, তারা অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসেন। কার কাছে অর্ডার দেন জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের লোক আছে, তাদেরকে বললেই এনে দেয়।‘
এরপর তিনি নিচু স্বরে বলেন, ‘পুলিশ যদি জানতে পারে এসব বই বিক্রি করি, তাহলে অনেক ঝামেলা হবে। বিনামূল্যের বই বিক্রি করা তো নিষেধ। তাই যার তার কাছে বই বিক্রি করি না।’
শুধু বাকুশাহ মার্কেটে নয়, বইয়ের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বাজার বাংলাবাজারেও বিনামূল্যের বই পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিনামূল্যের বই বাজারে কিভাবে আসে জানতে চাইলে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, তারা পুস্তক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং উপজেলা শিক্ষা অফিস ও স্কুলের মাধ্যমে এসব বই সংগ্রহ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নীলক্ষেতের এক বই ব্যবসায়ী বলেন, এসব বইয়ের বেশিরভাগই আসে পুস্তক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে। তারা সরকারকে বই দেয় ঠিকই, কিন্তু নিজেরাও এসব বই বেশি করে ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর এক থানা শিক্ষা অফিসার এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব বই সাধারণত কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে বিক্রি করা হয় বলে আমার মনে হয়। কারণ তাদের উদ্দেশ্যই ব্যবসা করা। তারা শিক্ষাকে জিম্মি করে ইচ্ছামতো ব্যবসা করছে। তারা যখন আমাদের কাছে বইয়ের চাহিদা জানায়, কাগজপত্র দেখায় তখন আমরা বই না দিয়ে পারি না।’ তার প্রশ্ন, ‘সরকার সব স্কুলে শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দিচ্ছে। তাহলে এসব বই কেনে কারা?’
বিনামূল্যের বই বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হলেও তথ্যটা এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের অজানা। এনসিটিবি চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বুধবার সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি আপনার কাছ থেকেই এটা জানলাম। আগামীকাল অফিসে গিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করে পদক্ষেপ নেবো। বিনামূল্যের বই বিক্রি করা নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এটা কেউ করতেই পারে না।’
এসব বই বাজারে কিভাবে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, প্রকাশকরা হয়তো এসব বই আমাদের চাহিদার চেয়ে বেশি ছাপে। বাড়তি বইগুলো তারা বাজারে ছেড়ে দেয়। অথবা যারা টেন্ডার পায়নি তারাও এসব বই নকল করে ছাপে।’
/আরএআর/এএআর/