X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রভাব যার, পাহাড় তার!

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
১৪ জুন ২০১৭, ২৩:০৭আপডেট : ১৫ জুন ২০১৭, ১৭:৪১

বান্দরবানে পাহাড় ধস অবৈধভাবে পাহাড়ে বসতি গড়ে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন প্রভাবশালী একটি চক্র। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ঘর বানানো থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগও দিচ্ছেন তারা। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদেরও নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা। বলতে গেলে পাহাড়েরই নিয়ন্ত্রণ এই চক্রের হাতে। প্রশাসনের নাকে ঢগায় দিনের পর দিন পাহাড়ে এভাবে রাম-রাজত্ব কায়েম করলেও তাদের উৎখাতে কোনও পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বরং প্রভাবশালী চক্রের পেছনে রাজনৈতিক আশীর্বাদ থাকার কারণে পাহাড় দখলমুক্ত করতে অপারগ খোদ স্থানীয় প্রশাসন।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় পাহাড়ে রাজত্ব চালিয়ে আসছে প্রভাবশালী এসব চক্র। সরকারি দল-বেসরকারি দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি নয়, পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলে ক্ষমতার পালাবদল হলেও পাহাড়ে তাদের রাজত্বের কোনও পরিবর্তন হয় না। যুগের পর যুগ টিকে থাকে তাদের আধিপত্য।
বান্দরবানে পাহাড় ধসের পর উদ্ধার অভিযান শুধু প্রভাবশালী এসব চক্র নয়, বাস্তুহারা সংগঠনের নামেও চট্টগ্রামে দখল করা হচ্ছে পাহাড়। শক্তির মহড়া দেখিয়ে এ ধরনের সংগঠনগুলো পাহাড় ও সরকারি জমি দখলে নিচ্ছে। অভিযোগ আছে, পর্দার আড়ালে থেকে এসব সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা।
মতিঝরনা পাহাড়ে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রিকশাচালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রভাবশালী একটি চক্র রয়েছে, যারা পাহাড়ে জায়গা দখল করে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে। স্থানীয় কাউন্সিলরসহ রাজনৈতিক নেতারা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। টাকা দিলে তারা এখানে ঘর তোলার অনুমতি দেয়।’ দুই রুমের একটি ঘর তোলার অনুমতি নিতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা এই চক্রকে দিতে হয় বলে জানান তিনি।
একই পাহাড়ের আরেক বাসিন্দা কুমিল্লার আক্তার হোসেন বলেন, ‘টাকা দিয়ে ঘর তোলার অনুমতি নিলেও অনেক সময় সেই ঘরে থাকতেও দেওয়া হয় না। ঘর তোলার পর তা জোর করে দখল করে সেখানে অন্যদের ভাড়া দেয় ওই প্রভাবশালী চক্রটি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড়ে ঘর তোলার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে হয়। স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনুমতি ছাড়া এখানে কিছুই করা যায় না।’
রাঙামাটিতে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পাহাড় দখলের বিষয়টি স্বীকার করেছেন পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুল জলিল। তিনি বলেন, ‘পাহাড়গুলো দখল করে কারা সেখানে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করছেন, তা আপনারাও ভালো করে জানেন। দখলকারীরা রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকায় আমরা চাইলেও তাদের উচ্ছেদ করতে পারছি না।’
এ কে খান পাহাড় ও মতিঝরনা এলাকায় বসবাসকারী একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মতিঝরনা এলাকায় একটি রুমে থাকার খরচ দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আর দুই রুমের খর তিন থেকে চার হাজার টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীতে সরকারি ছয়টি সংস্থার মালিকানাধীন পাহাড় রয়েছে সাতটি। অবৈধ দখলে রেখে সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র এসব পাহাড় থেকে ভাড়ার নামে প্রতি মাসে আয় করছে ৫০ লাখ টাকারও বেশি।
অবৈধ দখলে থাকা সাতটি পাহাড়ের মধ্যে গণপূর্ত অধিদফতরের মালিকানায় রয়েছে আমবাগান এলাকার বাটালি হিল, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মালিকানায় রয়েছে টাইগার পাসের মোড়ে ইন্ট্রাকো সিএনজির পেছনের পাহাড়, লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড়, বিশ্ব কলোনি বড় পানির ট্যাংকির পাহাড় ও ওয়াসার মতিঝরনা পাহাড়। বাকি পাহাড়গুলোর মালিকানা রেলওয়ের।
বান্দরবানের পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি অভিযোগ রয়েছে, এসব পাহাড়ের তত্ত্বাবধানকারী সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তবে সরকারি সংস্থাগুলোর দাবি, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকার কারণেই অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব আব্দুল জলিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড়গুলো যেসব সংস্থার মালিকানায় রয়েছে, তাদের কোনও তৎপরতা না থাকায় দখলদারিত্ব বাড়ছে। মালিকরা উদ্যোগ না নিলে সেখানে আমাদের করার কিছু থাকে না। এরপরও পাহাড় ধসে জান-মালের ক্ষতি এড়াতে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়।’ পাহাড়ের দখলদারদের উচ্ছেদে সরকার, রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে মৃত্যু হয় ১০৫ জনের অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, গত তিন দশকে চট্টগ্রাম নগরীতে শতাধিক পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এসব পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে আবাসন। নগরীতে বর্তমানে টিকে রয়েছে মাত্র ৮৬টি পাহাড়। তবে এগুলোর অস্তিত্বও বিপন্ন। এই ৮৬টি পাহাড়ের মধ্যে অক্ষত রয়েছে মাত্র ১৩টি। অবশিষ্ট ৭৩টি পাহাড় কেটে আবাসনসহ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের পাঁয়তারা চলছে। এই ৭৩টি পাহাড়ের মধ্যে কিছু পাহাড়ের এক-তৃতীয়াংশ ও কিছু পাহাড়ের দুই-তৃতীয়াংশ এরই মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। প্রায় ৫০টি পাহাড়ের ওপরে-নিচে ও আশপাশে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ৯০৭টি বস্তি।
অধ্যাপক কামাল হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় ব্যবস্থাপনায় যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার ছিল, প্রশাসন তা করতে পারেনি। এ কারণেই পাহাড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে। পাহাড়কে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে অপব্যবহার করেছি, করছি আমরা। তাই প্রকৃতি আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে।’

আরও পড়ুন-

ন্যাড়া আর খোঁড়া পাহাড়ই ধসে পড়ছে

পাহাড় ধসে চার জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৪৬

ধসে পড়া পাহাড়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানোই কঠিন

পাহাড় ধস: আহতদের চিকিৎসায় ৪৮৩ মেডিক্যাল টিম

দুর্নীতি বন্ধ না হলে থামবে না পাহাড় ধস, মৃত্যুর মিছিল

/টিআর/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দলবল নিয়ে উঠান বৈঠকে ফাঁকা গুলি ছোড়ার অভিযোগ বদির বিরুদ্ধে
দলবল নিয়ে উঠান বৈঠকে ফাঁকা গুলি ছোড়ার অভিযোগ বদির বিরুদ্ধে
লাইনে দাঁড়িয়ে ১০ টাকার টিকিট কেটে চোখ পরীক্ষা করালেন প্রধানমন্ত্রী
লাইনে দাঁড়িয়ে ১০ টাকার টিকিট কেটে চোখ পরীক্ষা করালেন প্রধানমন্ত্রী
স্বজনদের প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন ওবায়দুল কাদের
স্বজনদের প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন ওবায়দুল কাদের
দুর্নীতির দায়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারকে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা
দুর্নীতির দায়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারকে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক