মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বিচ্ছিন্ন ভাসানচরে অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ঘোষণার পর এ চরকে ঘিরে নানামুখী তথ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পাশাপাশি কৌতূহলও দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি চরটি ঘুরে এসেছেন বাংলা ট্রিবিউনের স্টাফ রিপোর্টার শাহেদ শফিক। ভাসানচর নিয়ে তার ধারাবাহিক ৬ পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের কারণে রাখাইন রাজ্য থেকে দলে দলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ঘোষণার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ভাসানচর এলাকা ঘুরেও এসেছেন। চরটির সম্ভাব্য উন্নয়নের নানা দিক নিয়েও বিশ্লেষণ চলছে। তবে কোন পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের সেখানে পুনর্বাসন করা হবে সে সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আপাতত দুটি পদ্ধতিতে তাদের পুনর্বাসনের চিন্তাভাবনা করছে স্থানীয় প্রশাসন। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে—গুচ্ছগ্রাম ও আশ্রয়ন প্রকল্প। এরমধ্যে পুনর্বাসনের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে গুচ্ছগ্রাম পদ্ধতিটি ভালো বলে মনে করছে স্থানীয় প্রশাসন। হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
ভাসানচর নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চমহল থেকে বিভিন্ন তথ্য ও মতামত চাওয়া হচ্ছে। এসবের ভিত্তিতে সম্প্রতি নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব আলম তালুকদার কী পদ্ধতিতে কতজন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পুনর্বাসন করা যায় সে বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে তথ্য চেয়েছেন। হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও প্রাথমিকভাবে ওই দুটি পদ্ধতিতে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের বিষয়ে খসড়া রূপরেখা তৈরি করেছেন।
জেলা প্রশাসকের জন্য তৈরি করা ওই খসড়া প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গুচ্ছগ্রাম ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাতিয়ার ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বর্তমানে বরাদ্দ করা পাঁচ হাজার একর জমিতে গুচ্ছগ্রাম পদ্ধতিতে আড়াই লাখ ও আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে চার লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে পুনর্বাসন করা যাবে। এ দুটি পদ্ধতির মধ্যে গুচ্ছগ্রাম পদ্ধতিটিকে বেশি মানসম্মত বলা হয়েছে। কারণ, আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাস তুলনামূলকভাবে কষ্টসাধ্য।
খসড়া ওই প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, ভাসানচরে বর্তমানে জমির পরিমাণ ১৩ হাজার একর। এরমধ্যে অতি জোয়ারে জলমগ্ন থাকে দুই হাজার ৬০০ একর। পুরো চরটিতে খাল ও শাখা খালের জমির পরিমাণ এক হাজার ৫০০ একর। এতে পাঁচ হাজার একর জমিতে গুচ্ছগ্রাম বা আশ্রয়ণ প্রকল্প করা যেতে পারে। বাকি তিন হাজার ৯০০ একর ভূমি বেড়িবাঁধ, রাস্তাঘাট, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, স্যানিটেশন, নলকূপ, পুকুরসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে ভাসানচরের আয়তন ১৩ হাজার একর। এই মুহূর্তে পাঁচ হাজার একর বসবাসযোগ্য। বাকিটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার উপযোগী হবে। এখানে যদি আমরা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করতে চাই, তাহলে সরকারের পুনর্বাসন পদ্ধতি অনুযায়ী হয়ত গুচ্ছগ্রাম বা আশ্রয়ণ প্রকল্প করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি গুচ্ছগ্রাম করে দেই, তাহলে প্রতি পাঁচ একর জমিতে ৫০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা যাবে। তাহলে চরের পাঁচ হাজার একর জমিতে সর্বমোট ৫০ হাজার পরিবার পুনর্বাসিত হবে। প্রতিটি পরিবারে যদি গড়ে পাঁচ জন করে সদস্য ধরা হয়, তাহলে এ প্রকল্পের মাধ্যমে মোট আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করা যাবে।’
অন্যদিকে, আশ্রয়ণ প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পাঁচ হাজার একর জমির মধ্যে প্রতি ৪০ একরে একটি করে মোট ১২৫টি আশ্রয়ণ করা যাবে। প্রতিটিতে ৭০০ পরিবার ধরা হলে প্রতিটি আশ্রয়ণে ৮৭ হাজার ৫০০ পরিবার থাকতে পারবে। একটি পরিবারে যদি পাঁচ জন করে সদস্য ধরা হয় তাহলে আশ্রয়ণ প্রকল্পে মোট চার লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ জন রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করা যাবে। গুচ্ছগ্রামের চেয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পে দ্বিগুণ লোক রাখা যায়। তবে এসবই হচ্ছে প্রাথমিক ধারণাভিত্তিক পরিকল্পনা, চূড়ান্ত কিছু নয়।’
গুচ্ছগ্রাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গুচ্ছগ্রামের উপকারিতা হলো- এর বাসিন্দারা বসবাসের জন্য ঘরের পাশাপাশি আঙিনায় কিছু খালি জায়গাও পাবে। একটা পুকুর থাকবে। প্রতি ছয়-সাতটি পরিবারের জন্য একটি গভীর নলকূপ থাকবে। এই ‘গ্রামে’ বসবাসকারীরা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে পারবে। অন্যদিকে, আশ্রয়ণ প্রকল্প হলে অনেক মানুষ একসঙ্গে বসবাস করবে, একসঙ্গে থাকবে। তবে সেখানে গুচ্ছগ্রামের মতো এত সুযোগ-সুবিধা থাকবে না।’
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম আরও বলেন, ‘শুধু ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর থেকে ভাসানচরে সরেজমিন জরিপ করার জন্য আমাদের কাছে একটা চিঠি এসেছে। এরই মধ্যে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে ভাসানচরের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলে আমরা প্রতিবেদন দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন,‘এখনও অনেক কিছু বাকি রয়েছে। জরিপ শেষ হওয়ার পর বলা যাবে সেখানে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো বিবেচনা করেই সামনে পা বাড়াতে হবে। বাস্তব চিত্র নিয়ে কথা বলা যাবে। আগে এখানে যেকোনও ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রাকচার করে ওই চর বসবাসের উপযোগী করতে হবে। তারপর হয়তো বসতি স্থাপন সম্ভব হবে।’
হাতিয়ার ভাসানচর জেলা সদর থেকে প্রায় ৭২ কিলোমিটার দূরে। এটি হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ৩৫ কিলোমিটার এবং নলচিরা ঘাট থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অন্যদিকে, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মূল ভূখণ্ড থেকে চরটির দূরত্ব ৭ কিলোমিটার।
আরও পড়ুন:
ভাঙা-গড়ায় নড়বড়ে ভাসানচর (ভিডিও)
কতটা বাসযোগ্য ভাসানচর? (ভিডিও)
জোয়ারে ডোবে ভাটায় ভাসে