আজ ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস। ২০০৭ সালের এই দিনে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ঘোষণা দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। এরপর একে একে ১০টি বছর কেটে গেলেও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয়। পাশাপাশি মাসদার হোসেন মামলার আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেটও প্রকাশ হয়নি।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর দেশের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ওপর বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। এটা বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ।
বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও এর কোনও অগ্রগতি হয়নি। সচিবালয়ের জন্য সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে জায়গা নির্ধারণ করে এর ফলক উন্মোচন হয়েছে, কিন্তু কাজ এগোয়নি আর ।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার লক্ষ্যে ১৮ বছর আগে সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার আদেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। এই ১২ দফার মধ্যে বেশকিছু দফা সরকার বাস্তবায়িত করলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দফা।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনালে মাহবুবে আলম বলেন, ‘মাসদার হোসেন মামলার আলোকে ১২ দফা প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন নিশ্চয় হয়েছে।’ তবে বিচার বিভাগ স্বাধীনতার জন্য পৃথক সচিবালয় জরুরি নয় বলেও জানান তিনি।
মাহবুবে আলম বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভর করে একজন বিচারকের দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে বিচারিক কাজ করার ওপর। প্রত্যেক বিচারকের যদি সেই জ্ঞান, নিষ্ঠা ও দক্ষতা থাকে তাহলেই বিচারপ্রার্থীরা স্বাধীন বিচার পাবেন।’
নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃংখলা সংক্রান্ত বিধিমালা হবে বলেও জানান রাষ্ট্রের এই প্রধান আইন কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগ কখনও চায় না বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হোক। তারা বিচার বিভাগকে তাদের আয়ত্তে রেখে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এই কারণেই কোনও রাজনৈতিক সরকারের আমলে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘১/১১ সরকারের সময় মাসদার হোসেন মামলার আলোকে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয়। কিন্তু ১০ বছর পার হওয়ার পরও যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়েছিল, তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। কেননা, এখনও নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন এবং বিবিধ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশ করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়। কিন্তু নিম্ন আদালতের বিচারকদের কাজ পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের জনবল ও অবকাঠামো থাকা দরকার।’ আজ পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে তা করা হয়নি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ১০ বছর পূর্ণ হলেও সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তাতে বিচার বিভাগ তার স্বাধীনতা থেকে অনেকটা পিছিয়ে গেছে।’
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনা বাস্তবায়নে তাগিদ দেওয়ায় আজকে প্রধান বিচারপতিকে এ অবস্থায় পড়তে হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন আইনজীবী সমিতির এ নেতা।
তিনি দাবি করেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় পুরোপুরিভাবে বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে।’
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধুমাত্র নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধি সংক্রান্ত গেজেটটি প্রকাশ হয়নি এবং বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবলায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। তবে বিচারক এবং বিচার বিভাগ সংক্রান্ত কোনও বিষয় নির্বাহী বিভাগের অধীনস্ত নয়।’ শিগগিরই বাকি কাজও সম্পন্ন হবে বলেও আশা করেন তিনি।
জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে পৃথক সচিবালয় করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সরকারের অনাগ্রহের কারণেই এখনও তা হয়নি।
এদিকে, আইন মন্ত্রণালয় এখনও বিচার বিভাগের সচিবালয়ের দায়িত্ব পালন করছে। আলাদা সচিবালয় না হওয়ায় বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন এখনও আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিয়ে পদোন্নতি ও বদলি করছে আইন মন্ত্রণালয়। তবে উচ্চ আদালতের বিচারকদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন-কাঠামো হয়েছে।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের যে ঐতিহাসিক ১২ দফা নির্দেশনা ছিল, তা হচ্ছে-
১. সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না
২. বিচারিক (জুডিশিয়াল) ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে এবং নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না। সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদ সৃষ্টি, নিয়োগ পদ্ধতি, নিয়োগ বদলিসহ অন্যান্য কাজের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারবেন।
৩. সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থী।
৪. এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। এই কমিশনে নারী ও পুরুষ বলে কোনও বৈষম্য থাকবে না।
৫. সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।
৬. সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন।
৭. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।
৮. বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।
৯. জুডিশিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনও হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে।
১০. জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।
১১. এই রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য সংবিধানে কোনও সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথকীকরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধানের সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে।
১২. জুডিশিয়াল পে-কমিশন: জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।
আরও পড়ুন: