১২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার, দুপুর সোয়া ১টা। সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকা ভারতের শিলং সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরে প্রবেশ করে উত্তর দিকে কয়েকশ' ফুট সামনে এগিয়ে গেলেই উপজেলা সদরের সবজি বাজার। গোয়াইনঘাট থানার মাত্র ৫০ গজের মধ্যেই বাজারটির অবস্থান। নামে সবজি বাজার হলেও ভেতরে তরি-তরকারি, শুঁটকি আর মাছের দোকানের চেয়ে চায়ের স্টলের সংখ্যাই বেশি। বাজারে ঢুকতেই দেখা গেল, বৃদ্ধ থেকে তরুণ ও মধ্যবয়সীরা চা পান ও খোশগল্পে মশগুল। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই স্মার্টফোন। একবার চায়ের কাপে চুমুক দেন তো, একবার চোখ রাখেন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। এরইমধ্যে এ প্রতিবেদক সেখানে পৌঁছালে ঘুরে ঘুরে দেখেন অনেকে। কেউ কেউ তো চোখের পাতা না ফেলে অপলক তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন প্রতিবেদককে। হঠাৎ করেই খেয়াল হলো— হলুদ টি-শার্ট গায়ে দেওয়া মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি এই প্রতিবেদকের গতিবিধি ও নড়াচড়াকে কেন্দ্র করে চারপাশে ঘুরে ফিরছেন।
এভাবে প্রায় ১৫ মিনিট পরিস্থিতির ওপর নজর রেখে এক কাপ চায়ের অর্ডার করতেই স্টলের বাইরে সামনের একটি টেবিলে বসা দুই ব্যক্তি খাতাপত্র গোছাতে শুরু করলেন। স্টল থেকে হাত দশেক দূরত্বে সাইনবোর্ডবিহীন দোকানের বারান্দায় বসেছিলেন ওই দু’জন। কড়া গোলাপি রঙের ছোট-ছোট চেকবই গুজলেন কোমরে। আশপাশের মানুষদের আচরণেও কেমন অস্বস্তি। স্টলের টেবিলে বসে চা পানে ব্যস্ত অন্য দু’জন মধ্যবয়সী ব্যক্তি পুরো চা শেষ না করেই হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে গেলেন। এভাবে পার হলো আরও কিছু সময়।
আরও মিনিট ১৫ এ প্রতিবেদকের দৃশ্যত নির্লিপ্ততা দেখে ব্যস্ত লোকেরা আবার কাজে নেমে পড়লেন। চা স্টলের সামনের টেবিলে বসে থাকা সেই দু’জন খুলে বসলেন খাতা। পাকা দালানে তৈরি সাইনবোর্ডবিহীন দোকানটির সামনেও আগের দু’জন ব্যক্তি কড়া গোলাপি রঙের চেকবই কোমর থেকে বের করে বসে পড়লেন টুলে। তবে এতক্ষণেও প্রতিবেদকের ওপর থেকে নজরদারি সরেনি। বরং সবজি বাজারের উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম কোণ ধরে লোকজনের ভিড়। বাজারের গা ঘেঁষে থাকা দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে অবস্থান করছেন অনেকে। প্রত্যেকের বয়স ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। আধঘণ্টা পর প্রতিবেদক তার মোবাইল ফোন বের করলে ধীরে ধীরে সবজি বাজারের উত্তর দিকে অবস্থান করা মানুষেরা সরতে শুরু করেন।
ক্যামেরা অন করে চায়ের স্টল, গ্লাসের দোকান, পেঁয়াজের দোকান, লাল শাক নিয়ে বসে থাকা আবু বকরসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলা শুরু হয়। আর সঙ্গে সঙ্গেই পালাতে থাকেন বাজারে উত্তরপ্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়ানো মানুষেরা। বাজারের উত্তর দিকে শেষপ্রান্তে দীঘির কোলঘেঁষে এগোলে আর কেউই ক্যামেরার দিকে মুখ করছেন না। কোনও কথা নেই, দৌঁড়ে পালাচ্ছেন গ্রামের মানুষেরা। তাদের কারও গায়ে শখানেক টাকা দামের টি-শার্ট, কারও গায়ে মলিন গেঞ্জি, ময়লা সাদা পাঞ্জাবি; আর প্রত্যেকের পরনেই লুঙ্গি।
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চললো এই পরিস্থিতি। বাজারের দোকানদারদের কেউই কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে রাজি নন। তবে কী হলো হঠাৎ যে দৌড়ে পালাচ্ছেন প্রায় শতাধিক মানুষ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে ফিরতে হবে ছোট্ট একটি গল্পে।
গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক আলী হুসেন বললেন, ‘এই দৌড়ে যাওয়া মানুষেরা আমাদের প্রতিবেশী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং থেকে নিয়ন্ত্রিত তীর খেলা নিয়ে ব্যস্ত। ঘর-পরিজন, সন্তানদের খোঁজখবর না নিয়ে সারাদিন, সারারাত শুধু এই জুয়ার ওপরে চলছে সবাই। সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ফলে, জুয়া খেলার স্থানে অপরিচিত কারও পা পড়লেই স্থানত্যাগ করে পালিয়ে যায় তারা।’
গ্লাস ফিটিংয়ে ব্যস্ত গোয়াইনঘাট বাজারের দোকানদার মাহবুব। বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘খেলে, কিন্তু কারা খেলে ইডা খইতাম পারতাম নায়।’
সিলেট মহানগরী থেকে শুরু করে জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের শিলং থেকে প্রচলিত ইন্টারনেট জুয়া ‘তীর শিলং’। এক টাকায় ৭০ টাকা পাওয়ার লোভে এ জুয়ার ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে কিশোর থেকে বৃদ্ধরা। স্থানীয়দের দাবি, এই জুয়ার ফাঁদে পড়ে অনেকেই যেমন গৃহহীন হয়ে পড়েছে, তেমনি আবার কেউ কেউ সাধারণ শ্রমিক থেকে হয়ে উঠেছেন কোটিপতি।
সরেজমিনে সিলেট মহানগরীর অন্তত ২০টি স্পট ঘুরে এটা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে যে জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলায় তীরশিলং জুয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সিলেটের বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর, জাফলং, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট এলাকাসহ সীমান্তঘেঁষা প্রতিটি গ্রাম ও পল্লিতে রমরমা চলছে এই জুয়া।
সিলেটের রাজনীতিবিদ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এই তীরশিলং জুয়া খেলাটি সিলেটজুড়ে মহামারী আকার ধারণ করেছে। এখনই এই খেলা বন্ধ না করলে ইয়াবার মতো পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে শ্রমঘাতী এই জুয়া।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তীর খেলা সিলেটে মহামারী আকার ধারণ করেছে। পাড়া থেকে মহল্লা সর্বত্র বৃদ্ধ-তরুণ-কিশোররা এই খেলায় জড়িয়ে পড়েছে।’
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দীন আসাদ সতর্ক করে বলেন, ‘এই জুয়া খেলা বন্ধ না করলে সব বয়সী মানুষই ধীরে ধীরে এতে যুক্ত হয়ে পড়বে। এতে দেশ ও জাতি সংকটে পড়বে।’
তীরশিলং জুয়ার প্রচলন বেশি গোয়াইনঘাটে। উপজেলার চেয়ারম্যান আবদুল হাকিম চৌধুরী স্বীকার করেন, তার উপজেলায় এই খেলা চলছে। কিন্তু প্রশাসন কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না।
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানালেন, স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় তীরশিলং খেলা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলেও ফল পাওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো জুয়াড়িদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মাসোহারা।
গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের এক তরুণ বললেন, ‘গোয়াইনঘাট থানার মাত্র ৫০ গজের মধ্যে সবজি বাজারে জুয়া খেলা হয়, কোনোদিন তো বন্ধ করতে দেখিনি।’ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয় না কেন— জানতে চাইলে উত্তর না দিয়ে মৃদু হেসে প্রস্থান করেন ওই তরুণ। কারা খেলে এই জুয়া? এ প্রশ্ন রেখেছিলাম স্থানীয় একটি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হুমায়ুন কবিরের কাছে। অনেক অনুরোধের পর কেবল বললেন, ‘বৃদ্ধরাই বেশি খেলেন।’
গোয়াইনঘাটের সাংবাদিক আলী হুসেন বলেন, ‘শুধু হাটে-বাজারে না, ঝোপঝাড়ে বসেও ছেলেরা তীরশিলং খেলে।’ গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এম এ মতিন জানান, হাটে-মাঠে-ঘাটে তীর খেলা ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘কারা খেলে সঠিকভাবে জানি না, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনও ব্যবস্থা নেয় না।’
গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাই, থানার এত কাছে কিভাবে কয়েকশ' মানুষ রীতিমতো দোকান খুলে জুয়া খেলছে? জবাবে ওসি বলেন, ‘অভিযান চালাই। তীরশিলং জুয়া এমন একটা খেলা, যার কোনও ডক্যুমেন্ট থাকে না, আলামত থাকে না।’
কিন্তু দিন-দুপুরে প্রকাশ্যেই মানুষ জুয়া খেলছে ব্যাপকহারে— এ কথা বললে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ব্যাপক হারে ঠিক না, গোপনে খেলতে পারে। মাঝে-মধ্যেই অভিযান চালাচ্ছি।’
উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হাকিম চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিটি সভায় আমি বলি, কালকেও (১৫ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার) বলব।’ পরে শুক্রবার আবার জানতে চাওয়া হলে ফোন রিসিভ করেননি আবদুল হাকিম চৌধুরী।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিৎ কুমার পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তীরশিলং জুয়া বন্ধে আমরা সচেতন। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। সিলেটে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। আর গোয়াইনঘাটের চেয়ে সিলেট নগরীর অবস্থা তো আরও বেশি খারাপ।’
তীরশিলং জুয়া ছড়িয়ে পড়েছে জৈন্তা ও কানাইঘাট এলাকায়। জৈন্তা উপজেলার তামাবিল রোডের দরবস্ত বাজারে প্রায় প্রতিটি চায়ের স্টলে জুয়াড়িরা দিনে-রাতে বসে মত্ত থাকে খেলায়। সরেজমিনে দরবস্ত বাজারের কানাইঘাটের দিকে যেতে ত্রিমুখী রাস্তার মোড়ের তিন পাশের চায়ের দোকানগুলোয় জুয়াড়িদের অবস্থান করতে দেখা যায়। সার্বক্ষণিক সতর্ক দৃষ্টি রেখে হাতের মোবাইল ফোনে একসঙ্গে খেলা চালিয়ে যেতে দেখা গেছে স্থানীয় ১২ থেকে ১৫ জনকে। দরবস্ত বাজার থেকে কানাইঘাট যাওয়ার মোড়ের কাছে স্টলের এক ব্যক্তিকে ‘গুটিখেলা’ নিয়ে কিছু বলতেই তিনি দ্রুত প্রস্থান করেন।
একই পরিস্থিতি কানাইঘাট উপজেলা, বিশ্বনাথ ও বিয়ানীবাজার উপজেলাতেও। তীরশিলং চলছে কানাইঘাটের চারখাই বাজারেও। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নিজের পরিচয় ও নাম গোপন করে জানান, প্রতিদিন সকালের পর এবং বিকালে জমে উঠে চারখাই বাজার। আর এই দুই সময়েই বেশিরভাগ চা স্টল, স্কুলের বারান্দাসহ বাজারের বিভিন্ন নিরিবিলি স্থানে জমে উঠে জুয়াড়িদের ভিড়। প্রশাসনসহ অপরিচিত কোনও ব্যক্তির উপস্থিতি টের পেলেই স্থান ত্যাগ করে জুয়াড়িরা। এমনকি খেলার সময় আশেপাশের সবাই সবার দিকেই নজর রাখে গুটি খেলোয়াড়েরা।
এদিকে, সিলেট মহানগরীর অন্তত ৩০টি স্পটে চলছে তীরশিলং জুয়া খেলা। সরেজমিনে নগরীর শেখঘাট, মহাজনপট্টি, সন্ধ্যা বাজার, শিবগঞ্জ, বালুচর, শাহী ঈদগাহ, টিলাগড়, মদিনা মার্কেট, টুকের বাজার, কাজিরবাজার মাছের বাজার এলাকা, তালতলা আনা ম্যানশন, কালিঘাট, লালবাজার, নয়াবাজার, টিভি গেইট, ছড়ারপার, আম্বরখানা, দক্ষিণ সুরমা, কামাল বাজার বেবিস্ট্যান্ড, বিমানবন্দর এলাকায় নয়াবাজারে দেখা গেছে তীর শিলং জুয়া খেলার আয়োজন।
পুরো সিলেটেই এই জুয়াটি একটি ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ এই খেলায় ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লেও এর পেছনে আছে সিলেটের প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের একটি নিবিড় পরিকল্পনা ও কৌশল। সঙ্গে রয়েছে প্রশাসনের ছত্রছায়া। বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কিছু নামও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা জুয়াড়িদের ধরি। পুলিশ চেষ্টা করছে। ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বন্ধ করার।’
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যেখানে খবর পাই, ধরি। এখন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। এই খেলার পেছনে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরও জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। আমরা তাদের বের করার চেষ্টা করছি। লোভের কারণে খেলে। এটা তো ইন্ডিয়া থেকে হচ্ছে।’
আগামী পর্ব: তীরশিলং জুয়া কী, কারা ছুড়ে দিচ্ছে তীর?