X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাড়া বৈষম্য থেকেই গেলো ট্যাক্সিক্যাবে

শাহেদ শফিক
১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ০৮:১২আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ০৮:১২

ট্যাক্সিক্যাব বৈধতা পাওয়া অ্যাপনির্ভর পরিবহন সার্ভিসের ভাড়া বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে। সোমবার (১৫ জানুয়ারি) মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন পাওয়া ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা-২০১৭’-এর খসড়ায় কোম্পানিগুলোকে ২০১০ সালের এ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসরণ করে ভাড়া আদায় করতে বলা হয়েছে। সরকারের এ দু’টি নীতিমালা, বর্তমানে ঢাকায় পরিচালতি তমা কনস্ট্রাকশন ও ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেসের ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিসের ভাড়া এবং অ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এগুলোর মধ্যে ভাড়ায় ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকেই। তারা দ্রুত বিষয়টির সুরহার দাবি করেন।

জনসাধারণের ভোগান্তি দূর করতে রাজধানী ঢাকায় ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিসের অনুমোদন দেয় সরকার। ২০০২ সালে সর্বপ্রথম এ সার্ভিস শুরু হয়। প্রথম অবস্থায় কালো ও হলুদ রঙের ১১ হাজার ২৬০টি ট্যক্সিক্যাব নামানো হয়। বিভিন্ন সমস্যায় সার্ভিসটি হারিয়ে গেলে পরে ২০১৪ সালের এপ্রিলে আবার নতুন সাজে ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস অনুমোদন দেয় সরকার। সে সময় তমা কনস্ট্রাকশন ও ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেস নামের দু’টি কোম্পানিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ট্যাক্সিক্যাব নামানোর অনুমতি দেওয়া হয়। বর্তমানে রাজধানীতে তমা সার্ভিসের ২৫০টি এবং ট্রাস্টের ১৭৫টি ট্যাক্সি চলছে।

এর মধ্যে ২০১৭ সালে অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সার্ভিস উবার-পাঠাওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস চালু করে। কিন্তু এতে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও তা সফল হয়নি। পরে এই পরিবহন সার্ভিসগুলোকে নীতিমালার আওতায় আনার উদ্যোগ নেয় সরকার।

সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে এ সংক্রান্ত ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা-২০১৭’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, রাইডশেয়ারিংয়ের বিষয়টি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হচ্ছে। বর্তমানে সরকারের ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস নীতিমালা-২০১০ অনুযায়ী এর ভাড়া নির্ধারিত হবে। তাছাড়া কোম্পানিগুলোকে ১১টি শর্ত মেনে চলতে হবে।

সরকারের ২০১০ সালের নীতিমালায় ট্যাক্সিক্যাবকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে— শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্যাক্সিক্যাব ও ইকোনোমিক ট্যাক্সিক্যাব। এর মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্যক্সিক্যাবের প্রথম ২ কিলোমিটারের জন্য ৬০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ১৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে, ইকোনোমিক ট্যাক্সিক্যাবের জন্য প্রথম ২ কিলোমিটারের জন্য ভাড়া ৫০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ভাড়া ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

পুরো কিলোমিটার পথ যাওয়ার আগে যাত্রী নেমে গেলে এক-চতুর্থাংশ কিলোমিটারে ইকোনোমিক ট্যাক্সিক্যাবে ৩ টাকা হারে ও শীতাতপ ট্যাক্সিক্যাবে ৩ দশমিক ৭৫ টাকা হারে ভাড়া দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সার্ভিসগুলোকেও ভাড়ার ক্ষেত্রে এই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সিক্যাবগুলোতে বর্তমান ভাড়া সরকারের নীতিমালায় উল্লেখ করা ভাড়ার তুলনায় কম। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করা তমা কনস্ট্রাকশন ও ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেসের ট্যাক্সিক্যাবগুলোর ভাড়া এই নীতিমালার চেয়ে অনেক বেশি। এসব ট্যাক্সিক্যাবে প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ৮৫ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৩৪ টাকা। প্রতি দুই মিনিট অপেক্ষমাণ সময়ের (যানজট, যাত্রাবিরতি ও সংকেত) জন্য ভাড়া সাড়ে আট টাকা এবং ফোনে বুকিং দিলে বাড়তি ২০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া ট্যাক্সিক্যাব যেখান থেকে যাত্রা শুরু করে, সেখান থেকেই মিটার চালু করা হয়।

এদিকে, অ্যাপভিত্তিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে উবারের ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৪০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ১৮ টাকা। প্রতি এক মিনিট ওয়েটিং চার্জ ৩ টাকা। সার্ভিস বাতিলের জন্য দিতে হয় ৩০ টাকা। এই কোম্পানির বাইক সার্ভিসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৩০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা এবং প্রতি এক মিনিট ওয়েটিংয়ের জন্য ১ টাকা হারে পরিশোধ করতে হয়।

অ্যাপভিত্তিক আরেক সার্ভিস পাঠাওয়ের সর্বশেষ নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী ট্যাক্সিক্যাবের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫০ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ২০ টাকা এবং প্রতিমিনিট ওয়েটিংয়ের জন্য ভাড়া ৫০ পয়সা। একই কোম্পানির বাইক সার্ভিসের সর্বনিম্ন ভাড়া ২৫ টাকা। ২ কিলোমিটারের পর কিলোমিটারপ্রতি ১২ টাকা এবং প্রতিমিনিট ওয়েটিংয়ের জন্য ৫০ পয়সা হারে ভাড়া ‍গুনতে হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন নীতিমালায় হুমকির মধ্যে পড়বে তমা ও ট্রাস্টের ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস। তাছাড়া, এরই মধ্যে অ্যাপনির্ভর সার্ভিসের কারণে লোকসানের আশঙ্কা জানিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে অভিযোগও জানিয়েছে এ দুই কোম্পানি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, যেখানে ২০১০ সালের নীতিমালা অনুযায়ী ট্যাক্সিক্যাবের প্রতি দুই কিলোমিটারের ভাড়া ৫০ বা ৬০ টাকা, সেখানে তমা ও ট্রাস্টের ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া ৮৫ টাকা অনেক বেশি। তাছাড়া এ দুই ধরনের সার্ভিসের মধ্যে পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়ায় ১২ থেকে ৩৪ টাকা পর্যন্ত ব্যবধান রয়েছে। ফলে নতুন নীতিমালায় এই দুই কোম্পানি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সচিব মুহাম্মদ শওকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আজই (সোমবার) মন্ত্রী পরিষদে নীতিমালার খসড়া অনুমোদন হয়েছে। এতে বিস্তারিত কী আছে, তা এখনও জানি না। নীতিমালা আমাদের হাতে এলে বিস্তারিত বলতে পারব।’

তিনি আরও বলেন, ‘অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাড়া কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এর কারণও আছে। আগে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করে আদায় করেছে। তখন তাদের ভ্যাট, ট্যাক্স, লাইসেন্স ফি দিতে হতো না। এখন তারা নিয়মের মধ্যে আসছে। তাদের সার্ভিসের সঙ্গে এই বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে। সে কারণে তাদের নির্ধারিত ভাড়া থেকে বর্তমানে কিছু ভাড়া বেশি দিতে হবে, যা ২০১০ সালের নীতিমালার সমান।’

তমা কনস্ট্রাকশন ও ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেসের ভাড়ার সঙ্গে অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাড়ার তারতম্য বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে।’

ঢাকা মহানগর ট্যাক্সিক্যাব (লিজ) মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ওবায়দুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা অবশ্যই বৈষম্য। এর মাধ্যমে ট্যাক্সিক্যাব শিল্পকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। এতে অবৈধ ট্যাক্সিক্যাবগুলোকে বৈধ করার জন্য উৎসাহ পাবে, বিপরীতে বৈধ ট্যাক্সিক্যাবগুলো নিরুৎসাহিত হবে।’

ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একই ধরনের সার্ভিসের ক্ষেত্রে যদি দুই ধরনের ভাড়া হয়, তাহলে যাত্রীরা তো কম ভাড়ার সার্ভিসেই উঠবে। সেক্ষেত্রে বর্তমান ট্যাক্সিক্যাবগুলোর ভাড়া বেশি হওয়ায় এগুলোতে যাত্রীরা উঠবে না। তখন সার্ভিসটি লোকসানে পড়বে।’ তিনি খুব দ্রুত ট্যাক্সিক্যাবগুলোর ভাড়ায় সমতা আনার দাবি জানান।

এ বিষয়ে তমা গ্রুপের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভুঁইয়া মানিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার নিশ্চয় যাত্রীদের সুবিধা বিবেচনা করেই ভাড়া নির্ধারণ করবে। আমরা তো এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত, চরম লুজার।’

অন্যদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি অ্যাপভিত্তিক কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের এখন লাইসেন্সের আওতায় আসতে হবে। বছর বছর লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হবে। এগুলো তো যাত্রীদের কাছ থেকেই আদায় করতে হবে। এখন সরকার নিয়ম করে দিলে আমাদের তা মানতে কোনও সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে যাত্রীদের বেশি ভাড়া গুনতে হবে।’

 

/টিআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
১৯ বছর পর হত্যা মামলায় স্বামী-স্ত্রীসহ ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
১৯ বছর পর হত্যা মামলায় স্বামী-স্ত্রীসহ ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের: মঈন খান
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের: মঈন খান
মোমবাতি জ্বালিয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা, ‘বিদ্যুৎবিভ্রাট’ বলছে কর্তৃপক্ষ
মোমবাতি জ্বালিয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা, ‘বিদ্যুৎবিভ্রাট’ বলছে কর্তৃপক্ষ
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি