X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াজ মাহফিলের যত ধারা

সালমান তারেক শাকিল
২১ মার্চ ২০১৯, ১১:০০আপডেট : ২১ মার্চ ২০১৯, ২১:৩৭

ওয়াজ মাহফিলের যত ধারা বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিল বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় বিভক্ত। এর পেছনে আদর্শ, বিশ্বাস, ধর্মপালনের রীতিনীতি ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অর্থের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন দেশের আলেমরা। তারা জানান, বাংলাদেশে মৌলিকভাবে পাঁচ ধারায় ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এগুলোরই প্রভাব পড়ে ওয়াজ মাহফিলে। পাঁচ ধারার মধ্যে আবার কওমি, মাজার-খানকা ও সালাফি অনুসারীদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে।

রাজধানীর আজিমপুর ফয়জুল উলুম মাদ্রাসার হাদিসের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মুফতি লুৎফুর রহমানের মতে, ‘আমাদের দেশে ওয়াজ মাহফিলে মোটামুটি পাঁচটি ধারা আছে। রীতিনীতি পালনের ক্ষেত্রেও পার্থক্য থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে কৌশল করার কারণে তা স্পষ্ট হয় না। পাঁচটি ধারার মধ্যে কওমি ধারা হলো উলামায়ে দেওবন্দের ধারা। এটি সবচেয়ে বড় ধারা। আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক আলেমদের ও মাজার-ওরসকেন্দ্রিক একটি করে ধারা আছে। চতুর্থ ধারা জামায়াত বা মওদুদীবাদের অনুসারীদের। পঞ্চমটি আহলে হাদিস বা সালাফি মতবাদের অনুসারীদের। এদের লা মাজহাবিও বলা হয়ে থাকে। কারণ, তারা মাজহাব মানে না বলে থাকে।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক ড. শাহ সৈয়দ এমরান বলছেন, ‘আমাদের দেশে ইলমে তাসাউফের চার তরিকার অনুসারীরাই আছেন। পীর সাহেবরা তাদের অনুসরণ করেন। ওয়াজ-মাহফিলে এরও প্রভাব আছে। এই চার তরিকা হচ্ছে— হযরত আবদুল কাদের জিলানীর কাদেরিয়া, হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর চিশতিয়া, মুজাদ্দেদে আলফে সানীর মুজাদ্দেদিয়া ও হযরত বাহাউদ্দিন নকশেবন্দির নকশবন্দিয়া তরিকা।’

কওমি বা দেওবন্দি ধারা

আলেমরা জানাচ্ছেন, কওমি বা দেওবন্দি ঘরানার মধ্যে তিনটি ভাগ আছে। একটি হচ্ছে সাধারণ ধারা, যারা কোরআন হাদিস থেকে আক্বিদা, তাওহিদ, বিদআ’তের নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করেন। এই ধারার অনুসারী বেশি। ‘উলামায়ে দেওবন্দ’ হিসেবে ঘরানাটি সবচেয়ে পরিচিত।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে পীরপন্থী ধারা। যারা জিকির, পীরের অনুসরণ ও রিপু দমনের বিভিন্ন কায়দা-কানুন সম্পর্কে সরাসরি পীরের কাছ থেকে জ্ঞান নিয়ে থাকেন। এই উপধারায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরমোনাই ধারা। এছাড়া উজানী, মধপুর, বরুনা, সন্দ্বপী পীর প্রমুখ ঘরানা আছে।

চরমোনাই ধারার পীর-মুরিদ ও অনুসারীদের সমন্বয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করছে ইসলামী আন্দোলন। গত কয়েক বছরে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে দলটি ব্যাপকভাবে আলোচনা সৃষ্টি করেছে। ইসলামী আন্দোলনের ছায়া সংগঠন মুজাহিদ কমিটির উদ্যোগে সারাদেশে ওয়াজ মাহফিল হয়ে থাকে। এসব আয়োজনে ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করিম,  নায়েবে আমির মাওলানা ফয়জুল করিম ও মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী অংশ নেন।

(ওপরে বাঁ থেকে) প্রয়াত মাওলানা ফজলুল করিম ও পীর চরমোনাই মাওলানা রেজাউল করিম (নিচে বাঁ থেকে) মাওলানা হাফিজুর রহমান ও ড. এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাই মুজাহিদ কমিটির দায়িত্ব পালন করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমেই চরমোনাইপন্থী ওয়াজ মাহফিলগুলো অনুষ্ঠিত হয়। রমজান ও কোরবানি ঈদের কয়েকদিন বাদ দিয়ে বছরের বেশিরভাগ সময়ই মুজাহিদ কমিটির মাহফিল থাকে।

ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের দাবি, ‘আমাদের নীতিমালায় আসলে মুজাহিদ কমিটি নেই। এটি ছায়া সংগঠন হিসেবে কাজ করে থাকে। ১৯৭৩ সালে মরহুম পীর হযরত ফজলুল করীম সাহেবের সময় থেকে মূলত কার্যকরভাবে সক্রিয় হয় মুজাহিদ কমিটি।’

‘মুজাহিদ কমিটির আমির হিসেবে আছেন ইসলামী আন্দোলনের আমির মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করিম। সংগঠনের নায়েবে আমির হিসেবে আছেন দলের নায়েবে আমির ফয়জুল করিম। তারা প্রায় প্রতিদিনই মুজাহিদ কমিটির মাহফিলে যোগ দেন’—জানালেন গাজী আতাউর রহমান।

আলেমদের কেউ কেউ মনে করেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মী সংগ্রহের মূল কাজ মুজাহিদ কমিটির মাহফিল থেকে হয়।

মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের দাবি, ‘মুজাহিদ কমিটি আত্মশুদ্ধির জন্য ওয়াজ মাহফিল আয়োজন করে থাকে। এই সংগঠনের কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই।’

১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকে প্রয়াত পীর ফজলুল করীমের নেতৃত্বে রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় হয় ইসলামী আন্দোলন। ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ ঢাকার মতিঝিলের একটি হোটেলে দলটির যাত্রা শুরু হয়। এই উদ্যোগে (মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত) মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যুক্ত থাকলেও আত্মপ্রকাশের দিনে তিনি সরে পড়েন। পরে মাওলানা ফজলুল করিম সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। আর মাওলানা সাঈদী জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হন। আত্মপ্রকাশের পর ১৩ মার্চ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠান করে ইসলামী আন্দোলন।

কওমিপন্থীদের মধ্যে তৃতীয় একটি উপধারা আছে। এটি হলো মজলিসে দাওয়াতুল হক নামের একটি সংগঠন। এর নেতৃত্বে আছেন যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা মাহমুদুল হাসান। সংগঠনটির আরেক জ্যেষ্ঠ আলেম মুফতি মানসূরুল হক। ওয়াজ মাহফিল আয়োজনে সবচেয়ে কঠোর নীতি পালন করে মজলিসে দাওয়াতুল হক। বাড়তি কিছু সংযোজন থেকে বিরত রাখায় কঠোরতা অবলম্বন করেন তারা।

(বাঁ থেকে) প্রয়াত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী, মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও মুফতি মানসূরুল হক মজলিসে দাওয়াতুল হকের আলেমরা জানান, ভারতের থানাভবনে মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর (রহ.) অনুসরণে এই ধারা গড়ে উঠেছে। এরপর ভারতের উত্তর প্রদেশে প্রয়াত মাওলানা আবরারুল হকের হাত ধরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এর চর্চা হয়। তার মৃত্যুর পর পাকিস্তানের প্রয়াত হাকিম আখতার ফারুক মজলিসে দাওয়াতুল হকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রয়াত মাওলানা আবরারুল হকের খেলাফত পেয়েছেন বাংলাদেশের কয়েকজন আলেম। তাদের একজন বর্তমান মজলিসে দাওয়াতুল হকের আমির। আর ‘মহিউস সুন্নাহ’ খেতাবপ্রাপ্ত হিসেবে আছেন যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসান। সংগঠনটির আরেক গুরুত্বপূর্ণ আলেম মুফতি মানসূরুল হক রাজধানীর মোহাম্মদপুর জামিয়া রাহমানিয়া (মানসূরুল হক) মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মুফতি হিসেবে কওমি অঙ্গনে পরিচিত এই আলেমও আবরারুল হকের খেলাফত পেয়েছেন।

আলেমরা বলছেন, মজলিসে দাওয়াতুল হকের আয়োজনে মাহফিলগুলোতে কতগুলো পদ্ধতি ও নিয়ম পালন করা হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য—ওয়াজের জন্য মসজিদ বা মাদ্রাসা বেছে নেওয়া, রাস্তা বন্ধ করে মাহফিল না করা, সীমাবদ্ধ এলাকায় মাইক বসানো, বেশি রাত অবধি মাহফিল না করা, বয়ানের জন্য হাদিয়া বা সম্মানী পেশ না করা, অনুমতি ছাড়া খাবারের আয়োজন না করা, বক্তার আগমনে স্লোগান না দেওয়া, মঞ্চে আলোকসজ্জা না করা ইত্যাদি। এসব নিয়ম মুফতি মানসূরুল হক কঠোরভাবে পালন করেন বলে জানান কয়েকজন আলেম।

মজলিসে দাওয়াতুল হকের অনুসারী মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার জামিয়াতুল আবরার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ফখরুদ্দীন। তিনি কঠোর নিয়ম মেনে চলার ব্যাখ্যা করেন এভাবে,  ‘প্রায় ৪০ বছর ধরে আমাদের দেশে মজলিসে দাওয়াতুল হকের কার্যক্রম চলছে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে ওয়াজ করলে মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। তাদের যেন ভোগান্তি না হয় ও রাতের ঘুমে যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য সঠিক সময়ে মাহফিল করা ভালো। মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম।’

মাওলানা ফখরুদ্দীন জানান, মজলিসে দাওয়াতুল হকের ওয়াজ মাহফিল ঢাকাতেই বেশি হয়ে থাকে। সারাদেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় সংগঠনটির চর্চা হয়।

আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধারা

সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি আলিয়া মাদ্রাসাকে ঘিরে আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধারাটি টিকে আছে। এর শীর্ষপর্যায়ের আলেমদের মধ্যে বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা সালাহউদ্দিন, প্রয়াত মাওলানা জালালুদ্দিন আল ক্বাদরী, ড. কফিল উদ্দিন সরকার অন্যতম। এছাড়া এই ধারার কয়েক হাজার আলেম আছেন, যারা আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেন। ‘সুন্নী’ মতাদর্শিক এলাকায় ওয়াজের জন্য ডাক পান তারা।

বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা সালাহউদ্দিন ও ড. কফিল উদ্দিন সরকার ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কর্মকর্তা ড. শাহ সৈয়দ এমরান মনে করেন, কওমি ও আলিয়া আলেমদের মধ্যে মতাদর্শিক খুব বেশি পার্থক্য নেই। তারা উভয় শ্রেণির আলেমই সুন্নী। তবে ১২ রবিউল আউয়াল মিলাদুন্নবীসহ কিছু বিষয়ে মতবিরোধ আছে। এরমধ্যে দাঁড়িয়ে দরুদ পড়া বা ‘কিয়াম’ করা নিয়ে ৪০ বছর ধরে কওমি ও আলিয়া আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ স্থায়ী আছে। দেশের সিলেট অঞ্চল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় কওমি ও আলিয়ার আলেমদের মধ্যে বাহাস (তর্কানুষ্ঠান) হয়।

ওরস ও মাজারকেন্দ্রিক ধারা

ওরস ও মাজারপন্থী হিসেবে চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ, আটরশি দরবার শরীফ, দেওয়ানবাগী দরবার শরীফ, শাহজালাল দরবার শরীফকেন্দ্রিক ওরস ও মাহফিল হয়ে থাকে। এসব মাজারকেন্দ্রিক অনেক বক্তা আছেন যারা ইতোমধ্যে সারাদেশে খ্যাতি পেয়েছেন।

(বাঁ থেকে) মাওলানা গিয়াস উদ্দিন তাহেরী ও ক্বারী শামীম রেজা অনেক ক্ষেত্রে মাজারে নাচ-গান করার অভিযোগ এনে কওমিপন্থীরা সমালোচনাও করে থাকে। কওমি আলেমরা এসব বিষয়কে ‘বিদআত’ হিসেবে আখ্যা দেন। দেওবন্দ বক্তাদের প্রত্যেকেই প্রকাশ্যে মাহফিলে এসব ঘরানার সমালোচনা করেন।

ভৈরবের একটি মাজার কমিটির দায়িত্বশীল সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল বলেন, ‘সুফি ঘরানার মাধ্যমেই উপমহাদেশে দ্বীন ইসলাম এসেছে। মানুষকে ইসলামের পথে নিয়ে আসার জন্য পীর-মাজার ও শায়খদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন দরবার ও খানকার মাধ্যমে ইসলামে শান্তির দিক তুলে ধরা হয়েছে। এসব দরবার ও খানকা অনুসরণ করে মানুষ শান্তির পথে থাকে।’

জামায়াতি ঘরানা

আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করা আলেমদের কয়েকজন জামায়াত ঘরানার বক্তা হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানের আবুল আলা মওদুদির মতাদর্শকে সামনে রেখে এই ধারার বক্তারা মাহফিলে বক্তব্য দেন। এর পুরোধা হিসেবে এখনও পরিচিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। জামায়াতে ইসলামীর এই নেতার হাত ধরেই জামায়াতি ঘরানার যাত্রা শুরু। এরপর মাওলানা কামালুদ্দিন জাফরী এটির প্রচলন চালু রাখেন।

(ওপরে বাঁ থেকে) মাওলানা কামাল উদ্দিন জাফরী ও মাওলানা আবদুল্লাহ আল মামুন (নিচে বাঁ থেকে) তারেক মনোয়ার ও মিজানুর রহমান আযহারী বিতর্কিত ইসলামি তাত্ত্বিক ভারতের জাকির নায়েকের বিষয়ে কওমি আলেমদের সঙ্গে জামায়াত ঘরানার বক্তাদের মধ্যে বিরোধ আছে। মাহফিলে জামায়াতপন্থী বক্তারা জাকির নায়েকের পক্ষে অবস্থান নিলেও কওমি বা আলিয়ার আলেমরা তার আক্বিদা ও ধর্মপালন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

মুফতি লুৎফুর রহমান মনে করেন, জামায়াতের ধারার মধ্যে সরাসরি ইসলাম শাসিত রাষ্ট্র ও সমাজ অগ্রাধিকার পায়। আবুল আলা মওদুদীর মতোই তারা মনে করে এছাড়া দ্বীন কায়েম সম্ভব নয়।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম উদ্ধৃত না করার শর্তে বলেন, ‘আলিয়া মাদ্রাসার মাহফিলকে অনেকটা সরিয়ে নিয়ে গেছে জামায়াতের আলেমরা। তারা ছাত্রজীবনে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আশির দশকে মাওলানা সাঈদী ওয়াজ মাহফিল করে আলোচনায় আসেন। এরপর ১৯৮৭ সালের দিকে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন তিনি। এরপর সারাদেশে সাঈদীকে কেন্দ্র করে ২-৪ দিনের তাফসির মাহফিল শুরু হয়।’

এই কর্মকর্তার দাবি, ‘জামায়াতের মাহফিলগুলোতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ থাকে, সম্মানী ভালো দেওয়া হয়। এই ঘরানার মধ্যে বর্তমানে কয়েক বক্তা আছেন, যাদের দুয়েকজন পরিচিতি লাভ করেছেন।’

সালাফিরা বিভক্ত ১৬ ধারায়

ওয়াজ মাহফিলের অঙ্গনে গত ৮-৯ বছর প্রকাশ্যে আসে সালাফিবাদ বা সালাফি মতাদর্শ। লা মাজহাবি বা ‘মাজহাব মানে না’ ধারার কয়েকজন আলেম ও অধ্যাপক এই মতাদর্শের প্রচারক হিসেবে কাজ করছেন। এটি ইতোমধ্যে অন্তত ১৬টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী একটি দেশের দূতাবাস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশের কোনও কোনও আলেম মনে করেন, সালাফিরা ৬টি ভাগে বিভক্ত।

সমালোচকরা সালাফিদের মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের অনুসারী হিসেবে ‘ওয়াহাবি’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকে। এই মতবাদের মূল ব্যক্তি অষ্টাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সালমান বিন আলী আত-তায়মী (১৭০৩-১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দ)।

কয়েকজন আলেমের অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যে লা মাজহাবিদের অনুসারী বেশি। তাদের অর্থায়নেই এদেশে সালাফিদের অনুসারী তৈরি হচ্ছে। ঢাকায় তাদের আলাদা মসজিদ রয়েছে। টাঙ্গাইল জেলায় নতুন নতুন মসজিদ তৈরি করে তারা নিজেদের মতাদর্শ চর্চা করছে।

মুফতি লুৎফুর রহমান বলেন, ‘সৌদি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদীর অনুসারীরাই লা মাজহাবি বা সালাফি। তাদের আক্বিদা মতভেদপূর্ণ।’

ড. খলিলুর রহমান মাদানী বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের সাধারণ সম্পাদক ড. খলিলুর রহমান মাদানী মনে করেন, বাংলাদেশে সালাফিরা ছয়ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের অবস্থান আছে। তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে, সালাফিরা এখন ছয়ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এগুলো হলো- ড. বারী গ্রুপ, প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব গ্রুপের আহলে হাদিস আন্দোলন, আবদুর রাজ্জাক ইউসূফী, ইলিয়াস আলী গ্রুপ, বংশালের আবদুস সামাদ গ্রুপ ও রাজশাহীর অধ্যাপক শামসুল আলম গ্রুপ।’

মাওলানা মাদানীর অভিযোগ, ২০১২-১৩ সাল নাগাদ সালাফিরা এদেশে প্রকাশ্যে আসে। সালাফিদের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে—২০১২-১৩ নয়, ১৯০৬ সালে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে ‘জমিয়তে আহলে হাদিস’ নামে উপমহাদেশে আহলে হাদিস অনুসারীরা প্রকাশ্যে আসে। পরে ১৯৪৬ সালে রংপুরে নিখিল বঙ্গ-আসাম জমিয়তে আহলে হাদিস গঠন করেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী নামে মুসলিম লীগের সাবেক একজন নেতা। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি এর দায়িত্বে ছিলেন। দেশভাগের সময় নাম পরিবর্তন হয়ে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে আহলে হাদিস নামে রূপান্তরিত হয়।

পরে আবদুল্লাহেল কাফীর ভাতিজা ড. বারী দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৩ সালে ইন্তেকাল করেন তিনি। তার মৃত্যুর পর সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক শামসুল আলম। ১৯৬০ সালে মোহাম্মদ আবদুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী মরণোত্তর বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।

ড. মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব ও কাজী ইব্রাহিম আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসূফ বাংলাদেশে আহলে হাদিস ও সালাফি মতাদর্শের বিষয়ে অধ্যাপক শামসুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইসলামের প্রথম সারির মুসলমান অর্থাৎ রাসুল (সা.) ও তার সাহাবীরা ও সাহাবীদের দেখেছেন, এমন ব্যক্তিরাই সলফে সালেহীন। তারা উত্তম মুসলমান।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক ড. শাহ সৈয়দ এমরান দাবি করেন, ‘সালাফিরা মুসলমানদের মধ্যে ফেতনা সৃষ্টি করছে।’

মসজিদ মিশনের সাধারণ সম্পাদক ড. খলিলুর রহমান মাদানীর ভাষ্য, ‘আহলে হাদিসের অনুসারীরা মাজহাব মানে না। আহলে হাদিস যুগের পর যুগ ছিল। কিন্তু মতবাদ আকারে ছিল না। তারা হাদিসপন্থী হিসেবে বলে নিজেরা মানুষেরা মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়, তারা উগ্রপন্থী। ইসলামের দুশমনরা তাদের আমদানি করেছে এদেশে। এরা টেলিভিশনে প্রোগ্রামের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যাপকভাবে টাকা ছড়ায় তারা।’

অধ্যাপক শামসুল আলম দ্বিমত প্রকাশ করেন বলেন, ‘জ্ঞান দুই ধরনের। একধরনের জ্ঞান ডান দিক থেকে ও আরেক ধরনের জ্ঞান বাঁ-দিক থেকে চর্চা হয়। যারা এক ধরনের জ্ঞানচর্চা করে তারা বিভ্রান্ত। আমরা দুই দিকের চর্চা করি। এজন্য আমাদের কটূক্তি হজম করতে হয়।’

মাজহাব না মানার বিষয়ে অধ্যাপক শামসুল আলমের ব্যাখ্যা, ‘সালাফি, লা মাজহাবি একই গোষ্ঠীর। আমরা মনে করি, যুগে যুগে পণ্ডিতরা এসেছেন, তারা শুধু ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কোনোটাই উপযুক্ত নয়। একমাত্র রাসুলের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। তার ২৩ বছরের যে জিন্দেগি, সেটাই আমাদের করণীয়-বরণীয়। চার মাজহাবসহ আরও যারা ইমাম আছেন, তাদের শ্রদ্ধা করি। তাদের কথা ততক্ষণ পর্যন্ত মানি, যতক্ষণ রাসুলের কথার বিপরীত না হয়। আমাদের লা মাজহাবি বলা হয়, আমরা এটাকে গালি মনে করি না।’

আহলে হাদিসের একাধিক দায়িত্বশীল জানান, বর্তমানে সারাদেশে ১৬টি গ্রুপে বিভক্ত আহলে হাদিস অনুসারীরা। কোনও গ্রুপ থানাকেন্দ্রিক, কোনও গ্রুপ জেলাভিত্তিক, কোনোটি শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক। এর মধ্যে ২-৩ জনের গ্রুপ আছে। সম্প্রতি মাওলানা ইব্রাহিম, মনজুরে আলম নামে কয়েকজন ব্যক্তি সহিহ আক্বিদা (সংস্কারপন্থী) দাবি করে আলাদা গ্রুপের চর্চা করছেন। ড. বারী গ্রুপের আমন্ত্রণে সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেছেন সৌদি আরবের ধর্মবিষয়ক একজন কর্মকর্তা। অধ্যাপক শামসুল আলমের পর ২০০৯ সাল থেকে জমিয়তে আহলে হাদিসের দায়িত্বে আছেন নারায়ণগঞ্জের অধ্যাপক মাওলানা মোবারক।

২০১৮ সালের ২২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে সফরে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে সৌদি প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান বলেন, “স্নায়ুযুদ্ধের সময় পশ্চিমা দেশগুলোর অনুরোধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলায় মুসলিম দেশগুলোতে ‘ওয়াহাবি মতবাদ’ বিস্তারে অর্থায়ন করে সৌদি আরব।”
আরও পড়ুন-

ওয়াজ মাহফিল কি পেশায় পরিণত হচ্ছে?
‘আল্লাহ বলেন নো-নো, মুসা বলেন ইয়েস-ইয়েস’

 

/জেএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ