X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোভিড হাসপাতালে নন-কোভিড চিকিৎসা: জনশক্তি ও অবকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন

জাকিয়া আহমেদ
১৩ জুন ২০২০, ২০:৪৭আপডেট : ১৩ জুন ২০২০, ২১:২৫

করোনাভাইরাস দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন মানুষজন। করোনা আক্রান্ত এবং সাধারণ রোগী সবাইকেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে। পজিটিভ সার্টিফিকেট হাতে না থাকায় করোনা আক্রান্তরা যেমন করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না, তেমনি করোনা আক্রান্ত নন, এমন রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে রোগীরা ভর্তি হতে পারছেন না, এমনকি ঘুরে ঘুরে অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যু হয়েছে এমন সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকের পরও যখন এই সমস্যার কোনও সুরাহা হচ্ছিল না, তখন এর সমাধানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একাধিক নির্দেশনা জারি করে। দেশে ৫০ শয্যা ও এর বেশি শয্যার যেসব হাসপাতাল রয়েছে, সেসব হাসপাতালে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়, সব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে সন্দেহভাজন কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। চিকিৎসা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও জরুরি চিকিৎসার জন্য আসা কোনও রোগীকে ফেরত দেওয়া যাবে না। দেশের কোনও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে উল্লিখিত নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধান অনুসারে লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তবে ৫০ শয্যার বেডে কীভাবে করোনার চিকিৎসা দেওয়া হবে জানতে চাইলে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'কাছাকাছি তো কোনোভাবেই করোনা রোগীদের সঙ্গে অন্যদের রাখা যাবে না। কোভিড ছোঁয়াচে রোগ, অসুস্থদের থেকে সুস্থদের দূরে রাখতে হবে, যেন কেউ কারও সংস্পর্শে না আসতে পারে। পাশাপাশি ওয়ার্ডও যদি হয় তাহলেও তো সমস্যা।'

তিনি মনে করেন, কোভিড রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক ব্যবস্থা করা যদি সম্ভব হয় তাহলে রক্ষা হতে পারে। নাহলে এটা হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

এদিকে সব হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা দরকার এবং তা বাস্তবায়ন করা উচিত জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, 'নন-কোভিড রোগীরা এই সময়ে চিকিৎসা নিতে পারছে না, অথচ অনেকেরই জরুরি চিকিৎসা দরকার। কিন্তু তারা চিকিৎসা করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। তাই যারা করোনায় আক্রান্ত, তারাও যেন সহজে চিকিৎসা পান, সেজন্য এই চিকিৎসা সুবিধা শুধু শহরে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, এই সুবিধা জেলা-উপজেলাতে নিয়ে যেতে হবে।'

এজন্য প্রস্তুতি দরকার উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এজন্য গাইডলাইন তৈরি করে দিতে হবে। কোভিড-নন কোভিডদের আলাদা রাখতে হবে, চিকিৎসক, নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।' এছাড়া ইনফেকশন কন্ট্রোলের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন মন্তব্য করে অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, 'যেন তারা নিজেরা আক্রান্ত না হন এবং নন-কোভিড রোগীরা যেন হাসপাতালে এসে কোভিডে আক্রান্ত না হন তা নিশ্চিত করতে এই বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগবে। তবে একসঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে কোভিড আক্রান্তরা যেমন ভালো চিকিৎসা পাবেন, পাশাপাশি নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা চাহিদাও পূরণ করা যাবে।'

অন্যান্য দেশের মতোই একই হাসপাতালে কোভিড-নন কোভিড রোগী থাকবে মন্তব্য করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'পরামর্শক কমিটি এটা বলেছে। কারণ অন্য রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এলেও পরীক্ষা করার পর অনেকেই কোভিড ধরা পড়েছে। তাই এসব রোগীর জন্য ফ্যাসিলিটিগুলো একই জায়গায় থাকা উচিত। আবার করোনা আক্রান্ত রোগীর অন্য চিকিৎসা দরকার হতে পারে।'  তাই এই সিদ্ধান্ত ঠিক আছে এবং সব হাসপাতালে করোনা রোগী  আসতে পারে এটা মনে করে চিকিৎসকসহ অন্যদের সঠিকভাবে সুরক্ষা নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

একইভাবে এই সিদ্ধান্ত ঠিক আছে জানিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'রোগীদের সমস্যা সমাধানের জন্য আক্রান্ত রোগীদের রেড জোনে, ঝুঁকি বা উপসর্গ রয়েছে এমন রোগীদের ইয়েলো জোন এবং বাকিদের গ্রিন জোনে চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলেছেন কমিটি।' হাসপাতালগুলোতে যদি এভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়, তাহলে সব হাসপাতালে একইসঙ্গে কোভিড-নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা নিতে কোনও সমস্যা হবে না বলেও জানান তিনি।

এই ব্যাপারে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান বলেন, 'কোভিড যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী হবে, তাই কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীদের একইসঙ্গে চিকিৎসা দেওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে। কিন্তু একই জায়গায় যদি চিকিৎসা দিতে হয়, তাহলে তার জন্য রেড-ইয়েলো এবং গ্রিন ইউনিট ভাগ করতে হবে এবং দেখতে হবে যেন একটার সঙ্গে আরেকটা ক্রস কন্টামিনেশন না হয়। ক্রস কন্টামিনেশন না হওয়ার মতো সেরকম ভৌত অবকাঠামো থাকতে হবে।'

সরকারি হাসপাতালে এটি করা সম্ভব হলেও বেসরকারি সব হাসপাতালে সম্ভব নয় মন্তব্য করে অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান বলেন, 'এসব হাসপাতালে ক্রস কন্টামিনেশন হবে না এটা সম্ভব নয়, সেখানে তো ফ্রি মিক্সিং হয়ে যাবে। তাই কিছু বেসরকারি হাসপাতালকে শুধু কোভিড নির্ধারিত আর কিছু হাসপাতালকে নন-কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারণ করতে হবে। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট একটাই, সেখানে কোভিড-নন কোভিড রোগীদের একসঙ্গে রাখা অবাস্তব।'

ডা. রিদওয়ানুর রহমানের মতোই বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়শন (বিএমএ)-এর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, 'বাস্তবতার নিরিখে এটা খুব কঠিন হবে।'

কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে সার্ভিস দিতে নন-কোভিড হাসপাতালের চেয়ে তিন গুণ বেশি জনবল দরকার হবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এমনিতেই হাসপাতালগুলোতে জনবলের সংকট, বলতে গেলে কম। সেখানে কোভিড-১৯ এবং নন-কোভিডের জন্য কীভাবে আলাদা ইউনিট করবে, সেটা আমি বুঝতে পারছি না। বিষয়টি লেজেগোবরে হয়ে যাবে।'

ড. ইহতেশামুল আরও জানান, করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে আরটিপিসিআর মেশিনের জন্য ল্যাবরেটরিতে বায়োসেফটি লেভেল-২ নিশ্চিত করে বসাতে হবে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সেই অবকাঠামো এবং বিশেষ এই নমুনা পরীক্ষা করার মতো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের সংকট রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একই হাসপাতালে কোভিড-নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তাদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। মন্ত্রণালয় সেসব বিবেচনা করছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান বলেন, 'কন্টামিনেশনের চান্স বর্তমানে বিশ্বে বসবাসকারী যে কোনও মানুষেরই রয়েছে। প্রতিদিন যত মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন, তারা যে হাসপাতাল থেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন তা নয়, বাইরে তো বটেই, বাসায় থেকেও একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হচ্ছেন। কাজেই একই হাসপাতালে চিকিৎসা হলে ঝুঁকি থাকবে বিষয়টা এভাবে চিন্তা করা ঠিক নয়। সাবধানতা অবলম্বন করে যে কেউ নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারেন।'

তবে ঝুঁকি কিছুটা থাকে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'চান্স তো অল্প-কিছু থাকেই। কিন্তু যদি সঠিক সাবধানতা অবলম্বন করে ঠিকমতো ট্রায়াজ ব্যবস্থা মেনে চিকিৎসা করা যায় তাহলে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আলাদা করে চিকিৎসা দিতে কোনও সমস্যা হবে না।’

/এএইচ/এফএএন/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
একদিন আগে নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাচন স্থগিত
একদিন আগে নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাচন স্থগিত
সরকার বিনিয়োগকারীদের সব সুবিধা নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর: পরিবেশমন্ত্রী
সরকার বিনিয়োগকারীদের সব সুবিধা নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর: পরিবেশমন্ত্রী
শীর্ষ ঋণখেলাপি লস্করের সম্পত্তি ওসির জিম্মায় দিলেন আদালত
শীর্ষ ঋণখেলাপি লস্করের সম্পত্তি ওসির জিম্মায় দিলেন আদালত
জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেও হিন্দুত্ববাদে ভরসা মোদির?
জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেও হিন্দুত্ববাদে ভরসা মোদির?
সর্বাধিক পঠিত
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র