X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সমন্বয়হীন মন্তব্যে জটিল হয়ে উঠছে পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলন

শফিকুল ইসলাম
২৯ জুন ২০২০, ১২:০০আপডেট : ২৯ জুন ২০২০, ১২:০০

পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলন (রাজশাহীর ফাইল ছবি)

সরকারি পাটকল বন্ধ এবং ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে বিদায় করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পাটকল শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। তারা বলছে সরকারি এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। প্রয়োজনে তারা আমরণ অনশন করবেন। এদিকে সরকারি পাটকলগুলোর শ্রমিকদের আন্দোলনে খুবই বিব্রত সরকারের ঊর্ধ্বতনরা। পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টমহলগুলো বার বার বৈঠক করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সরকারের শীর্ষমহলের নির্দেশ, যে কোনও পরিস্থিতিতে এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে হবে। তবে কয়েদিন ধরে পাটকল শ্রমিকদের এই আন্দোলন চললেও এখনও পর্যন্ত কোনও সমাধান করতে পারেনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া এবং এসব পাটকলে নিযুক্ত ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে দেওয়ার বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মন্তব্য বিদ্যমান সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে। পাট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- সরকারি পাটকলের ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে দেওয়া হবে। এর প্রক্রিয়া চলছে। আবার বিজেএমসির চেয়ারম্যান বলেছেন, এ বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত তাকে জানানো হয়নি। সিদ্ধান্ত জানলে বিজেএমসি ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। বিজেএমসি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী সংস্থা মাত্র।

এদিকে বেসরকারি কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছেন, 'সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হবে। পাটকলগুলো বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। এজন্য প্রক্রিয়া নির্ধারণ চলছে, তবে তা চূড়ান্ত হয়নি।' মন্ত্রীর এই বক্তব্য পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শ্রমিকরা বলছেন, যে কোনও মূল্যে পাটকল বন্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। এই সিদ্ধান্ত যে কোনও কিছুর বিনিময়ে রুখে দেবে শ্রমিকরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যন বলছেন, 'সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার কোনও সিদ্ধান্ত এখনও পাইনি। যে সিদ্ধান্তই হোক প্রজ্ঞাপন জারি হলেই বিজেএমসি ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। এর বেশি আমি কিছুই বলতে পারবো না।' তাহলে সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার যে কথা উঠেছে সেই সংবাদটি ভুয়া কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে বিজেএমসির চেয়ারম্যান বলেছেন, 'ভুয়া হবে কেনো? হয়তো ভেতরে ভেতরে সেরকম আলোচনাই চলছে, যা আমি এখনও জানি না।'

এদিকে সরকারি পাটকলের শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের (অবসর) বিষয়ে ইতোমধ্যে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। এখন মজুরি কমিশন অনুযায়ী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি চূড়ান্ত করে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী, সচিবসহ বিজেএমসির চেয়ারম্যান।

অপরদিকে কোনও অজুহাতেই সরকারি পাটকল বন্ধ না করে কলগুলোয় উন্নত প্রযুক্তির আধুনিক মেশিন সংযোজন করে পাটকল চালু রাখার দাবি জানিয়েছে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন। শুক্রবার (২৬ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই দাবি জানিয়েছেন সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কামরুল আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আমিরুল হক আমিন। বিবৃতিতে তারা বলেন, সরকারের উচ্চ মহলের বিবেচনায় রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ২৫টি পাটকল আদমজী জুট মিলের কায়দায় বন্ধ করে শ্রমিকদের কর্মের অবসান ঘটানো হবে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত অন্যায্য ও অযৌক্তিক।

জানা গেছে, বছরের পর বছর ধরে বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি পাটকলগুলো লোকসান দিয়ে আসছে। গত সাত (২০১১-১৮) বছরে পাটকলগুলোর লোকসান দাঁড়িয়েছে চার হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া বেতনও রয়েছে। ফলে বকেয়া বেতনের দাবিতে প্রায় প্রায় আন্দোলনে নামেন শ্রমিকরা। এই মুহূর্তে সারাদেশে চালু ২৫টি পাটকলের ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিকের বকেয়া বেতন-ভাতায় বছরে কয়েকশ কোটি টাকা গুণতে হচ্ছে। এই ২৫ হাজার শ্রমিকের মধ্যে বেশিরভাগই এখন আর কাজ করার সামর্থ রাখেন না। বয়সের ভারে শারিরীকভাবেই অক্ষম। অনেকে রাজনীতি করে সময় কাটান। অনেকেই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে। আবার অনেকে আছেন, দিনের বেশিরভাগ সময় কর্মকর্তাদের কাজকর্মের তোষামোদি করে সময় কাটান, নিজের কাজ করেন না। এই ধরনের অনেক অভিযোগ এই স্থায়ী শ্রমিকদের নিয়ে।

লোকসানের কারণ হিসেবে সরকারি পক্ষ শ্রমিকদের খামখেয়ালিপনা, কাজ না করা, দলাদলি করা, মাত্রতিরিক্ত ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা ইত্যাদিকে দায়ী করলেও শ্রমিকরা বলছেন অন্য কথা। তাদের দাবি, কর্মকর্তাদের দুর্নীতিই এর বড় কারণ। দক্ষতার অভাব, সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি, পাট কেনা থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় কার্যক্রমেও রয়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতি কমাতে পারলেই পাটকলগুলোকে আর লোকসানের ঘানি টানতে হবে না।

সরকারি পাটকলের লোকসান সম্পর্কে জানা গেছে, ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে মিলগুলোর সেটআপের শূন্যপদের বিপরীতে তিন ধাপে ৩০ শতাংশ করে মোট ৯০ শতাংশ শ্রমিক স্থায়ী করায় মজুরি বেড়েছে। এটি লোকসানের একটি কারণ। একই সময় প্রয়োজন ছাড়াই ছাঁটাই করা সাড়ে চার হাজার শ্রমিককে পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে ওই সব শ্রমিকরে বেতন ভাতা ও মজুরি বাবদ ব্যয় বেড়েছে, এটিও লোকসানের আরেকটি কারণ। ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন মজুরি কমিশন কার্যকর করা হলে মজুরি আগের তুলনায় ৬৭ শতাংশ বেড়েছে, এই বাড়তি মজুরিও লোকসানের কারণ। বেসরকারি মিলগুলোর সর্বনিম্ন মজুরি পাঁচ হাজার ১৫০ টাকা (বেসিক ২৭০০ টাকা), অন্যদিকে সরকারি পাটকলগুলোর শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ১১ হাজার ৮৫ টাকা (বেসিক ৪১৫০ টাকা)। এসব ছাড়াও ৫০ দশকের পুরনো মেশিনের কারণে মিলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, এতে ব্যয় বেড়েছে। নিয়মিত শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ না করতে পারার কারণে পাটকলগুলোর গেটে ঘন ঘন মিটিংয়ে শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করছেন, কাজে যোগ দিচ্ছেন না তারা, এই সব ধর্মঘট ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, এতে পটকলগুলোর লোকসান দিন দিন বাড়ছে।

উল্লেখ্য, বিজেএমসির অধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পুরোদমে পাটকল ও ৩টি পাটকল নয়, ননজুট ইন্ডাস্ট্রি। পাটকলগুলোয় বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক আছেন ২৪ হাজার ৮৫৫ জন। এছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। জানা গেছে, ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন অনুযায়ী এই মুহূর্তে একজন স্থায়ী শ্রমিককে বিদায় করতে হলে তাকে একসঙ্গে পাঁচ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পাওয়া পরিশোধ করতে হবে। পাশাপাশি ওই শ্রমিক চাইলে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী একই প্রতিষ্ঠানে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজও করতে পারবেন। এই সুযোগও রাখতে হয়েছে।

রাজধানী ঢাকার আশেপাশে ও খুলনা অঞ্চলের পাটকলগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই মুহূর্তে পাটকলগুলোর উৎপাদন চলছে। সূত্র জানিয়েছে, জুলাই ও আগস্ট দুই মাস খাদ্য অধিদফতরের বস্তা তৈরির ক্রয়াদেশ রয়েছে। এগুলোই উৎপাদন করা হচ্ছে। এ কারণেই পাটকলগুলো চালু রয়েছে। যেখানে অস্থায়ী শ্রমিকরা কাজ করছেন।

জানতে চাইলে খুলনার প্লাটিনাম জুট মিল সিবিএ’র সাবেক সভাপতি খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, লোকসানের অজুহাতে পাটকল বন্ধ করার পাঁয়তারা চললেও এর জন্য শ্রমিকরা দায়ী নয়। পাটকলে লোকসান হয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষ নীতি নির্ধারণের কারণে। তিনি জানান, পাটকল বন্ধ হোক তা কোনও শ্রমিক চান না। সরকারি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে।

এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বারবার বলেছেন, আমরা অনেক ব্যস্ত সময় পার করছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, দেখছি কী করা যায়। আমাদের কিছুটা সময় দেন। দেখবেন ভালো সংবাদ পাবেন।

 

 

/এএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হিজবুল্লাহর ঘাঁটিতে ইসরায়েলি পাল্টা হামলা
হিজবুল্লাহর ঘাঁটিতে ইসরায়েলি পাল্টা হামলা
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
গরমে পানির সংকট রাজধানীতে, যা বলছে ওয়াসা
গরমে পানির সংকট রাজধানীতে, যা বলছে ওয়াসা
গরমে নাকাল পথচারীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করলো ফায়ার সার্ভিস
গরমে নাকাল পথচারীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করলো ফায়ার সার্ভিস
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়