চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ ৫০ দিন বিদেশে অবস্থানের পর ১৯৭২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও কথা নেই। জেনেভা থেকে ফেরার পথে নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন বঙ্গবন্ধু। বৈঠকের পর ইন্দিরা গান্ধীও ঘোষণা দেন—বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত দেবে না ভারত।
আগে স্বীকৃতি তারপর কথা
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আলোচনা হবে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়চিত্তে আবারও একথা জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলতে বাংলাদেশের কোনও আপত্তি নেই।’ প্রধানমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘চিন-আমেরিকার মধ্যকার আলোচনার সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার আলোচনায় কোনও মিল দেখার সুযোগ নেই।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা জানেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এক দেশ ছিল। অতঃপর বাঙালিরা যুদ্ধ করে পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করেছে। তাই আলোচনা অনুষ্ঠানের আগে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দেওয়া দরকার।’
এদিকে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, পাকিস্তান যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয় তবে যুদ্ধবন্দিদের ফেরত দেবে না ভারত। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের সরকার বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে।’
জনগণের সঙ্গে আছি থাকবো
জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি জনগণের সঙ্গে আছি, জনগণের পাশে থাকবো, আর জনগণের মাঝে থেকেই মরতে চাই।’ দীর্ঘ ৫০ দিন বিদেশে অবস্থানের পর ১৪ সেপ্টেম্বর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একথা বলেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। এসময় প্রিয় নেতার পাশে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও তার রাজনৈতিক সচিব উপস্থিত ছিলেন। এর আগে তিনি পরিবারের সদস্যসহ দেশে ফেরেন। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ‘অন্নপূর্ণা’ বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে অবতরণের সময় ‘জয় বাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ’, ‘নতুনবাদ-মুজিববাদ’ স্লোগানে নেতাকর্মীরা তাকে বরণ করে নেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, অসুস্থ অবস্থায় দেশ থেকে চলে যাই। তখন আমার অবস্থা ছিল মারাত্মক। আর কয়দিন দেরি হলে বাঁচতাম না। আমার পিত্তকোষে পচন ধরে গিয়েছিল। একমাত্র জনগণের দোয়া, আশীর্বাদ ও ভালোবাসায় দেশে ফিরে এসেছি। এজন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া।’ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত বঙ্গবন্ধু এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘জনগণের কাছে আমার মোবারকবাদ পৌঁছে দেবেন।’ তিনি এও বলেন, ‘মোবারকবাদ দিয়ে আমি জনগণকে খাটো করতে চাই না।’ তিনি জনগণের কল্যাণ সাধনে এগিয়ে আসার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বিদেশে অবস্থানকালে আন্তরিক আতিথেয়তার জন্য ব্রিটিশ, সুইজারল্যান্ড ও ভারত সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘আমার চিকিৎসার জন্য তারা যথেষ্ট করেছেন। ব্রিটিশ সরকার আরও কিছু দিন বিশ্রাম গ্রহণ করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই সময়ে দেশে না ফেরা অন্যায় হবে। দেশবাসীর কাছে ফিরে এসেছি।’
একনজর দেখার জন্য
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছ থেকে দুই চোখ ভরে একটিবার দেখার উদ্দেশ্যে এক বৃদ্ধা বঙ্গবন্ধুর শয়ন কক্ষে গিয়ে তার গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেন। বাড়ির নিচে কঠোর নিরাপত্তা থাকার পরেও এই বৃদ্ধা কোনোক্রমে বাইরে থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু যখন মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন, সেই সময়ে এই বয়স্ক নারী বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ওপর তলায় উঠে তার শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসায় নিঃশব্দে অশ্রুবর্ষণ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সুখ-শান্তি ও স্বাস্থ্যের জন্য হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। বঙ্গবন্ধুও সেই বৃদ্ধার ভক্তিতে আনন্দিত হন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ওরা মিথ্যাবাদী
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন—বর্তমানে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের সৈন্য নেই। ঢাকায় ফেরার আগে নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য রয়েছে বলে যারা প্রচার করে, তারা মিথ্যাবাদী।’ গত মার্চ মাসে নির্ধারিত সময়ের ১৫ দিন আগেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যারা এখনও বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি দাবি করে, তারা বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মাঝে কালিমা লেপন করতে চায়।’