X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১
রানা প্লাজা ধস

‘ঘুরে দাঁড়াব না কেন’

উদিসা ইসলাম
২৩ এপ্রিল ২০১৬, ১৭:০৮আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০১৬, ১৮:৫৮

ধসের পর রানা প্লাজা ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত শ্রমিকেরা সরকারি বেসরকারি সহায়তায় গত তিন বছরে ধীরে ধীরে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন। আহত শ্রমিকদের দাবি,  বেঁচে থাকার তাগিদে তারা  নিজ দায়িত্বেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তারা বলছেন, বেঁচে থাকার তাগিদে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবেই, আমরা ঘুরে দাঁড়াব না কেন? শুধু শ্রমিক নন, গার্মেন্ট মালিকেরা মনে করছেন, এতদিনে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠে তারারও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক-মালিকদের সঙ্গে আলাপকালে তারা এমন মন্তব্য করেন।
রানা প্লাজার গার্মেন্টকর্মী শিল্পী রাণী দাস।  ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে গার্মেন্টে কাজ শুরু করেন তিনি। রানাপ্লাজা যখন ধসে পড়ে তখনও তিনি কাজ থামাননি। এরপর একটা বড় কাঁপুনি টের পান, তারপর দেখেন ধ্বংসস্তূপে মেশিনের নিচে চাপা পড়ে আছে বাম হাত আর ডান পা। কিছুক্ষণ পর টের পান তার আশেপাশে পড়ে আছেন শত-শত মানুষ, যাদের অনেককে তিনি চেনেনও না। শিল্পী তিনদিন আটকে ছিলেন লাশের সঙ্গে, মৃতপ্রায় মানুষের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম উদ্ধারকারীরা আমাকে দেখেছেন কিন্তু আমাকে উদ্ধার করতে হলে আমার সামনে থাকা আরও শ পাঁচেক মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। তাই দেরি হয়েছে। ওই সময়টায় আমি শুধু দোয়া করেছি, যদি একবার বাবা-মাকে দেখতে পেতাম, তাহলে আর কিছু চাইতাম না। সেই মনের জোরই হয়তো আমাকে বাঁচিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের দশ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র নিয়েই চলছেন শিল্পী। কারখানায় ফেরা হয়নি, ফিরেছেন স্কুলে। সাভারে ক্লাস নাইনে পড়ছেন তিনি। কেন পড়ালেখা শুরু করলেন জানতে চাইলে শিল্পী বলেন, আমার হাত নেই, গ্রামের মানুষ সারাক্ষণ নেতিবাচক কথা বলে। তাই চলে এসেছি। হাস্যোজ্জ্বল চেহারার শিল্পী বলেন, আমি ভালো আছি। যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তারা সবাই যেন ভালো থাকেন। তবে জীবনটা চেয়েছিলাম অন্যরকম করে সাজাতে, সেটা হলো না। এখন কেবলই অন্যের মতো করে বেঁচে থাকা।

আরও পড়তে পারেন:  ‘ঘুরে দাঁড়াব না কেন’ রানা প্লাজা ধস: ৫৮ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছে

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিকেরা সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় গত তিনবছরে ধীরে-ধীরে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন। তবে, পুনর্বাসনের চেষ্টা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যতই থাকুক, বেঁচে থাকার তাগিদে নিজেদের মতো করে, নিজেদের চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন শ্রমিকেরা। তারা বলছেন, বেঁচে থাকার জন্যই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আমরা ঘুরে দাঁড়াব না কেন?

তবে, যেসব শ্রমিক করেন, তাদের আয় রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছে এবং এ কারণে যারা স্বস্তি বোধ করেন, তাদের প্রতি খেদ ঝেড়ে অন্য শ্রমিকেরা বলছেন, আমরা শ্রমিক, নিজের জীবনের পরিকল্পনা আমার নিজের অধিকার রয়েছে। রানা প্লাজায় হাত-পা আর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যখন অন্যের দয়ায় আমাকে দোকান আর গরু পালন করতে হয়, তখন রক্তে আগুন জ্বলে।

রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিক শিল্পী রাণী দাস এর সঙ্গে কথা বলছেন প্রতিবেদক

রানা প্লাজায় আহত কবির মোল্লা সরকারি বেসরকারি সহায়তা পেয়েছেন কিন্তু কোথায় যেন প্রাণ কাঁদে। তিনি বলেন, আমার ছোটভাইয়ের বউ মারা গেছেন রানাপ্লাজায়। তার ছোট মেয়েটা আমাকে বলে, তুমি ফিরলে, আমার মা কেন ফিরলেন না। উত্তর দিতে পারি না। আমি ১৩ বছর ধরে কাজ করছি। আমার চোখের সামনে ২০জন মারা গেছেন। লাশের ওপর কিভাবে যে শুয়ে থেকেছি চারদিন, তা আল্লাহ জানেন। তিনি বলেন, কারখানার প্রতি ভালোবাসা থেকেই ১২ থেকে ১৩ঘণ্টা করে কাজ করেছি। এর বিনিময়ে স্বপ্ন ছিল ধীরে-ধীরে বড় জায়গায় যাওয়ার। শ্রমিকের ঘামের আলাদা টান আছে। সেই আমরা কেমন যেন দয়া-দাক্ষিণ্যের জীবন পেলাম।

কেবল শ্রমিক নন, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের মাধ্যমে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প যে বড় ধরনের একটি সংকটের আভাস দেখা গিয়েছিল, তিন বছর পর এখন সেই শিল্প অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন গার্মেন্ট শিল্প মালিকেরাও। তিন বছর পর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানি ২০১২-১৩ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে বেড়েছে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯.৮ শতাংশ।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে নিহত হয়েছেন ১১৩৫ জন শ্রমিক। রানা প্লাজার নয়টি তলায় অবস্থিত পাঁচটি পোশাক কারখানায় এসব শ্রমিক কাজ করতেন। জীবিত উদ্ধার করা হয় ২৪৩৮ জনকে। ক্লেইমস কমিটির মাধ্যমে এবং বেসরকারিভাবে এ সব শ্রমিক পরিবার এক লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২২ লাখ পর্যন্ত অর্থ অনুদান পেয়েছেন।

রাবেয়া বেগমের শরীর ভাঙা বিমের নিচে আটকা পড়ায় তার পাজরের হাড় ভেঙে যায়। পঙ্গু হাসপাতাল, বক্ষব্যধি হাসপাতাল থেকেছি সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রতে (সিআরপি) চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা বেঁচে আছেনতো বটেই কিন্তু মেলেনি কোনও সহায়তা। তিনি বলেন, সবাই বলে এত টাকা দিয়েছি, এই-সেই দিয়েছি। কখনও শ্রমিকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছেন, তারা কী পেয়েছেন? লাখ-লাখ টাকা তাদের কই গেল?

আরও পড়তে পারেন:  বাংলাদেশ-তাইওয়ান পতাকা তাইওয়ানের ত্রাণ ফেরত পাঠালো বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, রানাপ্লাজার জন্য অনেক সংগঠন নানাভাবে কাজ করেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিল। তারা কে, কী কাজ করছেন, পরস্পর জানা থাকলে শ্রমিকদের জন্য সেটা বেশি কাজের হতো। তিনি বলেন, মুখে-মুখে ছড়ানো হয় এনাম মেডিক্যালে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের ব্যক্তিগতভাবে অনেক মানুষ ২২লাখ থেকে ৭০লাখ পর্যন্ত সহায়তা করেছেন, যা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। আমাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ বলে, এটা একেবারেই সত্য নয়। তিনি বলেন, আমার মনে হয় এভাবে তথ্যহীনভাবে টাকার অঙ্ক বলার কারণে সমাজে ও পরিবারে শ্রমিকরা আরও বেশি ভঙ্গুর হয়ে গেছে। তাদের কেউ বিশ্বাস করে কাজ দিতে চান না।

ছবি : নাসিরুল ইসলাম

/এমএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সফলতায় কিছুটা দায়মুক্ত হয়েছি: মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সফলতায় কিছুটা দায়মুক্ত হয়েছি: মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী
ক্রিমিয়ায় মার্কিন নির্মিত ৪টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিতের দাবি রাশিয়ার
ক্রিমিয়ায় মার্কিন নির্মিত ৪টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিতের দাবি রাশিয়ার
‘খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছেন’
‘খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছেন’
পশ্চিমবঙ্গ জয়ে এবার মোদির ত্রিপুরী সেনা!
পশ্চিমবঙ্গ জয়ে এবার মোদির ত্রিপুরী সেনা!
সর্বাধিক পঠিত
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে