X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

রানা প্লাজা ধস: ৫৮ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছে

উদিসা ইসলাম
২২ এপ্রিল ২০১৬, ২০:১৩আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০১৬, ২০:৩২

২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে কেউ হারিয়েছেন মা, কেউ বাবা। কেউ হারিয়েছেন দুজনকেই। শ্রমিক সংগঠন ‘গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্যফোরাম’, ‘শ্রমিক ফেডারেশনের’, ‘সাভারে গার্মেন্ট শ্রমিকদের স্কুল সংকলন পাঠশালা’র হিসাব মতে, এই দুর্ঘটনায় বাবা-মা হারানোর প্রায় ৫৮ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছে। তবে, নিহত-আহত শ্রমিকদের তালিকা করতে গিয়ে তাদের সংসারে কতজন শিশু ছিল, এ নিয়ে তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। সরকারি-বেসরকারিভাবে শিশুদের দেখাশোনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কতজন শিশু পারিবারিক জীবন হারিয়েছে, সেই তালিকাই নেই। সন্তান কোলে দুর্ঘটনায় ডানহাত হারানোর শ্রমিক রিক্তা

শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্য মতে, প্রায় ৫ হাজার শ্রমিকের পরিবারে ৭০০ শিশু ছিল, যারা বর্তমানে হয় মা বা বাবা অথবা দাদি-নানির কাছে বেড়ে উঠছে। এ সংখ্যা আরও বেশি বলে তাদের ধারণা। এর মধ্যে নানা পর্যায়ে ৩শ জন অর্থাৎ ৪২ শতাংশ শিশুর পড়ালেখার ব্যবস্থা করে দেওয়া সম্ভব হলেও বাকিদের খোঁজ কেউ রাখেননি। পরিবারের পক্ষ থেকে শিশুদের আলাদা থাকতে হবে ভেবেও অনেক মা-বাবা ‘হোম’ এ দিতে চাননি শিশুদের। তারা বলছেন, বাড়িতে রেখে পড়ানোর জন্য কেউ সহযোগিতা করলে আত্মীয়দের মধ্যেই বড় হতে পারত শিশুরা।

১২ বছরের শিশু শুভ। পড়ত সাভারের একটি স্কুলে। বাবা বাদল মিয়া রানা প্লাজার চারতলায় ফিনিশিং বিভাগে কাজ করতেন। গ্রামের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা। রানাপ্লাজা ধসের ঘটনায় বাবাকে হারানোর পর থেকে নানাভাবে বদলে যেতে থাকে তার জীবন। তার অনেক বন্ধুই মায়ের সঙ্গে  গ্রামের বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। মা শিউলী আক্তার এখন নিজের বাসায় কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।

আরও পড়ুন:

ছাত্রী হেনস্তা: বহাল তবিয়তে উত্তরা মেডিক্যালের শিক্ষক হাবিব

রেহানা স্বামী হারানোর পর সন্তান নিয়ে চলে গেছেন পাবনা। স্বামীর লাশ পেলে টাকা পাবেন বলে জানানো হয়েছিল কিন্তু স্বামীর পরিবারের কাউকে চিনতেন না রেহানা। শুনেছিলেন স্বামী এতিম। ধসের ঘটনার কয় মাস পরই তিনি চলে যান সন্তান নিয়ে মামার বাড়িতে। এখন যেটুকু আত্মীয়রা দেন, সেটুকুর ওপরই চলে। ৮বছরের সন্তান সোহেলকে তিনি কোথাও পড়তে দেননি। রেহানা কেবল সন্তানের বড় হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। তার আশা, ছেলে আয় করলে আর আত্মীয়দের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।

জুনায়েদের বয়স এখন ৫ বছর। আর বোন জোয়ারিয়ার ৭ বছর। রানা প্লাজায় একটি গার্মেন্টে সুইং অপারেটরের কাজ করতেন তাদের বাবা দীন ইসলাম। এই দুই সন্তানের মা ইয়াসমিন পাননি স্বামীর লাশ। কোনও অনুদান না পাওয়ায় ইয়াসমিনের জীবন চলছে কোনও মতে। তিনি জানেন না এই দুই শিশুকে তিনি কোন জীবন উপহার দিতে চলেছেন। রানাপ্লাজ ধসের ঘটনায় নিহত শ্রমিক মর্জিনা আক্তারের ছেলে মোহাম্মদ আলিফ

শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিজেদের রাখা তথ্যমতে যে ৭০০ শিশু বাবা বা মাকে হারিয়েছে, তাদের মধ্যে প্রায় ২ শ জনকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নাম করা নানা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে বিজিএমইএ। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ হোমে আশ্রয় ও শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে ১৪ শিশু এবং আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে ১৭জন শিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ১২ অনাথ শিশুর দায়িত্ব নিয়েছে। এরপরও কিছু ছেলেমেয়েদের পরিবার বাধ্য হয়ে নানা প্রতিষ্ঠানের কাছে দিয়েছেন কিন্তু কোথায় কাকে পাঠানো হয়েছে এর কোন সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই। রানা প্লাজার পাশে গড়ে ওঠা সংকলন পাঠশালায় বিনামূল্যে পড়ছে ১৭জন। যাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। আহসানুল্লাহ মিশন, স্নেহা ফাউণ্ডেশন কিছু ছেলেমেয়ের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছিল।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক। রানা প্লাজার নয়টি তলায় অবস্থিত পাঁচটি পোশাক কারখানায় এসব শ্রমিক কাজ করতেন। জীবিত উদ্ধার করা হয় ২ হাজার ৪৩৮ জনকে। ক্লেইমস কমিটির মাধ্যমে ও বেসরকারিভাবে এসব শ্রমিকের পরিবার ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ অনুদান পেয়েছেন। সৎমা পারভীন আক্তারের সঙ্গে মোহাম্মদ আলিফ

রানা প্লাজার পাঁচটি পোশাক কারখানায় যারা কাজ করতেন, তাদের সন্তানরা সাভার এলাকারই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করত৷ সাভার সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়, মানিক চন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সাভার বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আশেপাশের স্কুলে পড়ত তারা।

ওই সময় বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি শহিদুল আজিম জানান, তারা যে শিশুদের দায়িত্ব নিয়েছি, তাদের যোগ্যতা অনুসারে নাম করা নানা স্কুলে কয়েক দফায় ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া ওই সময়ই আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম পরিচালিত আজিজুর রহমান বালিকা হোমসে কিছু শিশুর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচ হিসেবে বিজিএমইএ অর্থ দিয়ে থাকে। যতজন শিশুকে আমরা পেরেছি, মানবিক কারণেই জায়গা করে দিয়েছি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের  নানা বা দাদার বাড়ির লোকজন নিয়ে গেছেন, সেসব ক্ষেত্রে পরিবার না চাইলে তাদের জন্য কিছু করার থাকে না।সন্তান কোলে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক বিউটি আক্তার

রানাপ্লাজার ঘটনায় মিসিং লিস্ট বানিয়েছেন গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির নেতা তাসলিমা আখতার। শিশুদের বিষয়টিতে তারা কাজ করেননি জানিয়ে বলেন, আমরা আহত-নিহত শ্রমিকদের তালিকা বানিয়ে ক্ষতিপূরণের দাবিটাকে জিইয়ে রাখতে চেয়েছি। যেন তার পরিবার পরিজনরা কিছুটা ভালো থাকেন।

সাভারে গার্মেন্ট শ্রমিকদের স্কুল সংকলন পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা মনির হোসেন বিনামূল্যে পাঠদান করে থাকেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের হিসাবে রানাপ্লাজার কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ৭শ স্কুলশিক্ষার্থী ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ৩শ জনকে নানাভাবে ব্যবস্থা করে দেওয়া গেছে। তবে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি ঠিকমতো সুরাহা না হওয়ায় এই শিশুদের পুনর্বাসন নিয়ে নানা অনিয়ম থেকে গেছে।  ঠিক কত শিশু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি, বা যারা পরে স্কুলে ভর্তিযোগ্য হয়েছে, তাদের পরিস্থিতি কী হয়েছে, সেসব হিসাব কেউ রাখেননি। 

আরও পড়ুন:

বাংলাদেশ-তাইওয়ান পতাকা তাইওয়ানের ত্রাণ ফেরত পাঠালো বাংলাদেশ

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

/এমএনএইচ/আপ-এআর/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মুসলিমদের একাত্মতা ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মুসলিমদের একাত্মতা ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বৃষ্টির অপেক্ষায় নার্সারি ও গাছপ্রেমীরা
বৃষ্টির অপেক্ষায় নার্সারি ও গাছপ্রেমীরা
নিজ্জর হত্যার অভিযোগে কানাডায় তিন ভারতীয় গ্রেফতার
নিজ্জর হত্যার অভিযোগে কানাডায় তিন ভারতীয় গ্রেফতার
পিকআপের পেছনে ট্রাকের ধাক্কা, উল্টে গিয়ে ২ শ্রমিক নিহত
পিকআপের পেছনে ট্রাকের ধাক্কা, উল্টে গিয়ে ২ শ্রমিক নিহত
সর্বাধিক পঠিত
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে