ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ও বামপন্থী প্রগতিশীল ছাত্রজোট। গত এক সপ্তাহ ধরে চলমান এই অস্থিরতা ‘লড়াইয়ে’ রূপ নেয় মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) দুপুর থেকে। এদিন ঢাবির ভিসিকে আটকে রাখার অভিযোগ এনে তাকে ‘উদ্ধারে’ অভিযান চালায় ছাত্রলীগ। এসময় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মারধরে আন্দোলনরত বাম ছাত্রসংগঠনের কমপক্ষে ১০-১২ জন নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থী আহত হন।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। একদিকে ছাত্রলীগের আল্টিমেটাম, অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রজোটের ডাকা ধর্মঘট। ইতোমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ছাত্রসংগঠনগুলো মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। রাজশাহীতেও জোটের বিক্ষোভে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এসেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
জানতে চাইলে ছাত্র ফ্রন্টের (জামান) সভাপতি, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সমন্বয়ক ইমরান হাবিব রুমন বলেন, ‘সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। চট্টগ্রামে দ্বিতীয় দফা হামলা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে (বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে)। আমাদের আন্দোলন চলবে, যত হামলা বা বাধাই আসুক– আমাদের করার কিছু নেই। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করছি, এই সংগ্রাম চলবে। যত হামলাই আসুক আমরা প্রতিরোধ করব।’
তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোথাও ছাত্রজোটকে বাধা দেওয়ার কোনও নির্দেশনা নেই। আমরা বাধা দিতে চাই না। গণতান্ত্রিক অন্দোলনে বাধা নেই। প্রত্যেকের অধিকার আছে আন্দোলন করার। শান্তিপূর্ণ অন্দোলনে সহায়তা প্রয়োজন হলে করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগের আন্দোলন–যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে, যারা ভিসির ওপর হামলা করতে চাইছে, যারা অছাত্রদের দিয়ে আন্দোলন করাতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন।’
জাকির বলেন, ‘বাম-সন্ত্রাসীদের আক্রমণে আমাদের কুয়েত মৈত্রী হলের শ্রাবণী শায়লার অবস্থা আশঙ্কাজনক। কিছুদিন আগে তার অপারেশন করা হয়েছিল দেশের বাইরে। কালকে (২৩ জানুয়ারি) ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়েছে।’ পরে হাসপাতাল থেকে কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক আঁখি জানান, শ্রাবণী শায়লার অ্যাপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন হয়েছিল। এখন জ্বর আছে, বমি হচ্ছে।’
এ বিষয়ে ছাত্র ফেডারেশনের নেতা কাঁকন বিশ্বাস বলেন, ‘শ্রাবণী শায়লা ছাত্রীদের ওপর হামলা করেছে, এটা নিয়ে বলার কিছু নেই। সারাদেশের মানুষ জানে, তিনি কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের ওপর।’
বাংলা ট্রিবিউনের সিলেট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সিলেটের এমসি কলেজে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ওপর হামলা চালিয়েছে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে কলেজ ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন, নগর শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্তত ১০জন আহত হয়েছেন। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এমসি কলেজের শহীদ মিনারে ছাত্র ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠবার্ষিকীর র্যালি ও সমাবেশের প্রস্তুতিকালে এ হামলা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের মিছিলে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। দুপুর ১টার দিকে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের হামলায় প্রগতিশীল ছাত্রজোটের দুই কর্মী আহত হয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানার, ফেস্টুন কেড়ে নিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এ ঘটনায় আহতরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ফ্রন্টের সাবেক আহ্বায়ক ফজলে রাব্বি এবং একই সংগঠনের সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী রিজু লক্ষ্মী।
প্রগতিশীল ছাত্রজোটে ছয়টি সংগঠন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ফ্রন্ট (জামান) ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ঐক্য ফোরাম।
বুধবার ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে জোটের নেতারা ২৯ জানুয়ারি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দেন। এছাড়া, ২৬ জানুয়ারি শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সংহতি সমাবেশ এবং ২৮ জানুয়ারি সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবেন তারা। জোটের নেতারা চার দফা দাবিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এগুলো হচ্ছে মঙ্গলবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার, গত ১৫ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও মামলা প্রত্যাহার, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় প্রশাসনকে বহন করা এবং অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া।
প্রগতিশীল ছাত্রজোটের বিপরীতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিক্ষোভ করেছে ছাত্রলীগও। ‘বাম-সন্ত্রাসীদের’ বহিষ্কার করতে সংগঠনটি ঢাবি প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে। বুধবার সকালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের বহিষ্কার করতে হবে। আমরা গতকাল উপাচার্যকে বলেছি আমরা ঢাবির শিক্ষার্থী। হয় তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বহিষ্কার করতে হবে, নইলে আমাদের বহিষ্কার করতে হবে।
পরে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা আন্দোলনের নামে অছাত্রদের দিয়ে ক্যাম্পাসে অস্থিরতা তৈরি করতে চায়, ভিসির গায়ে হাত তুলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা চাই যথাযথ কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। আমরা সংঘর্ষের বিরুদ্ধে।’
এ বিষয়ে ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম সোহেল বলছেন, ‘সরকারি দলের ক্ষমতার মদদে ছাত্রলীগ এখন পুরোদস্তুর একটি সন্ত্রাসী লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা দখলদারিত্ব আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করছে। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি– হেন অন্যায় অপকর্ম নেই যা তারা করে না। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের দিক দিয়ে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের ভয়ংকর সন্ত্রাসী বাহিনী এনএসএফকেও ছাড়িয়ে গেছে। ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়নের মতো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো বরাবরই ছাত্রলীগের এই জুলুম-অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আর সহ্য করতে না পেরে ছাত্রলীগের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে। ছাত্রলীগ যদি সংযত না হয়, ভুল স্বীকার করে শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা না চায় তবে ছাত্রলীগের এমন শোচনীয় পতন হবে যে, ভবিষ্যতে আজকের সন্ত্রাসী ক্যাডাররাও ছাত্রলীগের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করবে।’
ঢাবিতে এই অস্থিরতার শুরু হয় গত ১১ জানুয়ারি। ওইদিন ঢাবি থেকে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল চেয়ে আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। ১৫ জানুয়ারি তারা উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের হুমকি দেন। ওইসময় কয়েকজন ছাত্রীকে নিপীড়ন করার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এর প্রতিবাদে ১৭ জানুয়ারি বামপন্থী কয়েকটি ছাত্রসংগঠন, ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি দল এবং সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারীরা প্রক্টরকে সাড়ে চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন। ওই ঘটনায় ৫০-৬০ জন অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা হয়। এরপর থেকে এই আন্দোলন চলছে।
আরও পড়ুন: চবিতে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা
ঢাবিতে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের বিক্ষোভ, ২৯ জানুয়ারি সারাদেশে ধর্মঘট