X
শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
৭ আষাঢ় ১৪৩২

কার ছবি কখন ছাপাবেন না

উদিসা ইসলাম
২৪ মার্চ ২০১৮, ১৬:৩০আপডেট : ২৪ মার্চ ২০১৮, ১৬:৩৭

কার ছবি কখন ছাপাবেন না

ভিকটিম নারী-শিশু কিংবা অভিযোগ গঠন হওয়ার আগেই কোনও ব্যক্তির ছবি প্রকাশ বা পরিচয় দিয়ে শনাক্তকরণও অপরাধ বলে মন্তব্য করছেন গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, শনাক্তকরণের মধ্য দিয়ে সামাজিক হয়রানি বাড়ে এবং তাদের পুনর্বাসনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইনজীবীরা বলছেন, শিশুরা অপরাধ করে না, ভুল করে।  তাদের শাস্তি হয় না বরং সংশোধনের ব্যবস্থা রেখেছে আইন। অথচ কোনও অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে অভিযুক্ত শিশুর ছবি প্রচারের মধ্য দিয়ে তার পরবর্তী জীবনকে নেতিবাচক করে তোলা হয়।

আর ফটোগ্রাফি করছেন যারা তারা বলছেন,এখন খানিকটা সতর্কতা বেড়েছে  তবে এখনও সেটা উল্লেখযোগ্য নয়। ছবি ছাপানোর কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমন যেন না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকা ফটোগ্রাফার বা ক্যামেরা পারসনের জন্য জরুরি। এমনকি তা জরুরি সর্বস্তরের গণমাধ্যমকর্মীদের জন্যেও।

জামালপুরের ঘটনা। প্রতারণা মামলায় দুই বছরের একটি শিশুকে আসামি করা হয়। অভিযোগ, ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর আসামিরা ১ লাখ ১২ হাজার টাকা নিয়ে বাদীর নামে সাড়ে ৪ শতাংশ জমি সাব কবলা দলিল করে দেওয়ার কথা থাকলেও দলিল করে দেয় দানপত্র হিসেবে। এরপরেও দখল বুঝিয়ে না দিয়ে তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। ওই মামলায় ৬ জন আসামির বয়স উল্লেখ করা হলেও গোপন করা হয় ৭ নম্বর আসামি শিশু আরিফের বয়স। সব আসামির বিরুদ্ধে সমন জারি করলে ২০ ফেব্রুয়ারি মা অবিরন বেওয়ার কোলে উঠে আদালতে হাজিরা দিতে আসে দুই বছরের শিশু আরিফ। বেশকিছু অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয় সপরিবারে সেই শিশুটির ছবি।

কিংবা ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাতে ‘ছোঁয়া পরিবহনের’ একটি বাসে করে সিরাজগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে ধর্ষণের শিকার হন রূপা। তাকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে লাশ ফেলে যায় ধর্ষকেরা। এ ঘটনার শুরু থেকে রায় হওয়ার দিন পর্যন্ত খবরে রূপারই নানা আঙ্গিকের ছবি প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। ধর্ষণের শিকার নারী নিহত হয়েছেন বলে ছবি দেওয়া যায়, এমন  যুক্তি দেখালেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি তার পরিবারের জন্য ক্ষতিকর কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।

গত ১৯ মার্চ শিশু আইন ২০১৩ এর ৯৭ ধারা অনুসারে কোনও মামলায় বা অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনায় কোনও শিশুর ছবি বা পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। রিটকারী আইনজীবী হাসান এম এস আজীম বলেন, ‘আইনের ৮১ ধারায় আছে মামলা বা বিচার কার্যক্রম চলাকালে শিশুকে শনাক্ত করা যায়, এমন ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু মামলার আগে কী হবে সেটা বলা নেই। তাই এ বিষয়ে অস্পষ্টতা দূরীকরণে এ রিট দায়ের করা হয়েছে।’

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ (১) ধারায় সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ অংশে বলা আছে,এই আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হইয়াছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তত্সম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোনও সংবাদপত্রে বা অন্য কোনও সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।

ধর্ষণের শিকার নারীর ছবি গণমাধ্যম এখন না প্রকাশ করলেও সে মারা গেলে ছবি প্রকাশের রেওয়াজ রয়ে গেছে। এটি মৃত ব্যক্তিকে অসম্মান করার শামিল উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সেই নারী মারা গেছে বলেই ছবি প্রকাশ জায়েজ হয়ে যায় না। ধর্ষণের শিকার সেই নারীর পরিবার পরিজন ও তাদের সমাজ রয়েছে। সেখানে পরিবারটিকে হেয় করা হয়। অনেকসময় গণমাধ্যম মাদকাসক্ত শিশুদের ছবি প্রকাশ করে। এটি শিশুটিকে ট্রমাটাইজ করে ফেলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, শিশুটি পরবর্তীতে মনে করে তার আর ভালো হয়ে কী লাভ, লোকে তাকে খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু করে দিয়েছে। শিশুরা অপরাধ করে না, তাদের দিয়ে অপরাধ করানো হয়। তাদের সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের ছবি প্রকাশ করা উচিত নয়।

বাংলাদেশে ফটোগ্রাফি শেখানোর প্রতিষ্ঠান পাঠশালার শিক্ষক আবীর আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,বাংলাদেশে ছবি ব্যবহারের কোনও লিখিত নীতিমালা নেই। বিভিন্ন দেশে পত্রিকা বা গণমাধ্যমগুলোর কোনও কোনোটির নীতিমালায় থাকে, ১৮ বছরের নিচে কোনও শিশু অপরাধ করে থাকলে তার ছবি ছাপানো যাবে না। একান্ত বাধ্য হলে সে ছবিটি অস্পষ্ট বা ঝাপসা (ব্লার) করে দিতে হবে যাতে তাকে চেনা না যায়। তিনি বলেন, টেক্সট বেইজড ফটো ও ভিজুয়াল বেইজড ফটো–দুই প্রকারের ছবির কথা আমরা বলি। ধরুন,  যখন আর্সেনিকের রোগীর ছবি ছাপতে পারছেন না, তখন কেবল টেক্সট যাবে, ছবি যাবে না।  আবার যখন কারও বিরুদ্ধে ডাকাতির কোনও মামলা হলো, সেই অভিযোগেই তার ছবি ছেপে দেওয়া যায় না। অন্তত অভিযোগ গঠন হওয়া পর্যন্ত এটা করা ঠিক নয়। গণমাধ্যমে কাজ করার সময় ফটোগ্রাফারদের সতর্ক থাকার জন্য কী ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন প্রশ্নে তিনি বলেন, অনুমতি না নিয়ে কারও ছবি তোলা যাবে না। অনুমতি নিতে গেলেই প্রশ্ন উঠবে কোথায় ছাপা হবে। আর শিশু ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই ভাবতে হবে এ ছবি ছাপার জন্য তারা কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কী না।

ভিকটিমের ছবি কিংবা শিশুর ছবি প্রকাশ করা কতটা নৈতিক সে বিষয়ে ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নৈতিক-অনৈতিকের বিষয় নয়; আইন দিয়েই এই বিষয়টি যেন না ঘটে, সেটি সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে। বাংলাদেশের সমাজে আমরা ক্ষমতাবানরা নির্যাতনের শিকার মানুষটিকেই অপরাধী ধরে নিই। ধর্ষণের শিকার নারীটিরই সব দোষ ধরে নিই। একই ঘটনা পশ্চিমে ঘটলে মেয়েটি নিজেই থানায় যায়, কারণ ওই সমাজে যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তাকে অপরাধী হিসেবে দেখা হয়। আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ঘুরেফিরে নারীটির ওপরই দোষ চাপাই বলেই সেই নারীর পরিচয় প্রকাশ পেলে সমাজে তার চলাফেরায় সমস্যা হয়। কোনও নারী যদি স্বেচ্ছায় নাম প্রকাশ করতে চান, করতে পারেন; কিন্তু সমাজ যেহেতু এটা এলাউ করে না, ফলে নাম-পরিচয় না দেওয়ার বিষয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের আইনে স্পষ্ট বলা আছে।’ 

এই বিধান লঙ্ঘন করলে দায়ীদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের কথাও বলা আছে আইনে। সেদিক থেকে গণমাধ্যমে সেই অপরাধটি অনবরত করে যাচ্ছে।

কেন এখনও ছবি ব্যবহারের নীতিমালা তৈরি করা গেলো না–এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সরকার কিছু চাপিয়ে দিক সেটাও যেমন পছন্দ করি না আবার সাংবাদিক সংগঠন, একাডেমিক যাদের এই কাজটি করার কথা তারা যথেষ্ট প্রফেশনাল নন, দলীয় হয়ে গেছে। প্রফেশনের উন্নতির জন্য যেহেতু তারা চিন্তা করে না, তাই এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথ্যাও নেই।’

 

/ইউআই/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশ হচ্ছে কাজী আনিস আহমেদের উপন্যাস ‘কার্নিভোর’
হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশ হচ্ছে কাজী আনিস আহমেদের উপন্যাস ‘কার্নিভোর’
জামিনে বেরোনোর আগেই নতুন মামলা: হয়রানির অভিযোগ
জামিনে বেরোনোর আগেই নতুন মামলা: হয়রানির অভিযোগ
যুক্তরাষ্ট্রে ৩ মাস পর মুক্ত ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারী মাহমুদ খলিল
যুক্তরাষ্ট্রে ৩ মাস পর মুক্ত ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারী মাহমুদ খলিল
নিয়ম ভঙ্গ করে মাদক বিক্রি, সেনাবাহিনীর অভিযানে আটক ৩
নিয়ম ভঙ্গ করে মাদক বিক্রি, সেনাবাহিনীর অভিযানে আটক ৩
সর্বাধিক পঠিত
বিভক্ত বিরোধীদের গণআন্দোলনের ডাক, ইরানি অ্যাক্টিভিস্টরা নীরব
বিভক্ত বিরোধীদের গণআন্দোলনের ডাক, ইরানি অ্যাক্টিভিস্টরা নীরব
অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ
অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ
ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে পুলিশে দেওয়ার সময় ছাত্রদল ও শিবিরের সংঘর্ষ
ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে পুলিশে দেওয়ার সময় ছাত্রদল ও শিবিরের সংঘর্ষ
শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেফতারের ঘটনায় উত্তাল রংপুর, ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেফতারের ঘটনায় উত্তাল রংপুর, ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ইকবাল বাহার আটক
সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ইকবাল বাহার আটক