‘সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দ দূষণের কবলে রয়েছে রাজধানীসহ সারাদেশ। বর্তমানে শব্দ দূষণ একটি মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বিশেষ করে শব্দ দূষণের কারণে নতুন প্রজন্ম মানসিক ও শারীরিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, খিটখিটে মেজাজ, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘ্নিত হওয়া, ঘুমের ব্যাঘাতসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়।এ বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।’
বুধবার (২৫ এপ্রিল) সকালে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস উপলক্ষে ‘ক্রমাগত শব্দ দূষণের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি: প্রভাব ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে পরিবেশবাদীরা এসব কথা বলেন।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) উদ্যোগে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। গোলটেবিলে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান।
তিনি জানান, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় শব্দ দূষণ বিধিমালা বলবৎ রয়েছে। এছাড়া, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তারপরও শব্দ দূষণের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতি থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী পদক্ষেপ। এ জন্য মানুষকেও সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগও করতে হবে।
প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, ‘শহর এলাকায় শব্দ দূষণের প্রকোপ গ্রামাঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি। ঘরের বাইরে, রাস্তায় বা কর্মস্থলেই নয়, ঘরে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি থেকেও বিরক্তিকর শব্দ বের হয়। তাছাড়া, যানবাহনের জোরালো হর্ন ও ইঞ্জিনের শব্দ, যানবাহন, বিভিন্ন নির্মাণ যন্ত্র, কলকারখানা নির্গত শব্দ, নির্বিচার লাউড স্পিকারের শব্দ, অডিও ক্যাসেটের দোকানসহ বিভিন্নভাবে উচ্চ শব্দে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।’
সভাপতির বক্ত্যব্যে পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট তারিখসহ একটি রোডম্যাপ প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করেন। তিনি জানান,শ্রবণ-শক্তি হ্রাসের ফলে বিরক্তি, নেতিবাচকতা ও রাগ, ক্লান্তি, চাপা উত্তেজনা, মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা, সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে পরিহার বা প্রত্যাহার, সামাজিক প্রত্যাখ্যান ও একাকীত্ব, সতর্কতা হ্রাস ও ব্যক্তিগত ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া, স্মৃতিশক্তি ও নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা হ্রাস; কর্মক্ষমতা ও উপার্জন শক্তি হ্রাস এবং মানসিক ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য খর্ব হয়ে থাকে। শব্দ দূষণের ফলে মানুষের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা ঘটতে পারে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান এবং পবার সম্পাদক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘উচ্চ শব্দ শিশু, গর্ভবতী মা এবং হৃদরোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়। মাংসপেশীর সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়। এর ফলে ট্রাফিক পুলিশও বধিরতাসহ মারাত্মক শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে শব্দ দূষণের মাত্রা নিরুপণের লক্ষ্যে ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর শব্দের মাত্রা জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জানুয়ারি ২০১৭ মাসে ঢাকা মহানগরীর নীরব, আবাসিক, মিশ্র ও বাণিজ্যিক এমন ৪৫টি স্থানে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। এছাড়া, বাসের ভেতরে, সামনে ও পেছনে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়।
এদিকে একই সময়ে শিশুদের নিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের সামনে ‘শিশুর সঠিক বিকাশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক এক শিশু সমাবেশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, গ্রিন ভয়েস, মাস্তুল ফাউন্ডেশন, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম, বিসিএইচআরডি, সিএসডবব্লিউপিডি, রায়েরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়, ধানমন্ডি কচিকণ্ঠ হাইস্কুল, ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুল এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট। এতে বলা হয়, শিশুদের সঠিক বিকাশে শব্দ দূষণই বাধা। এসময় শিশুদের জন্য খেলার মাঠসহ নিরাপদ ঢাকা গঠনের তাগাদা দেওয়া হয়।
সমাবেশে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর মারুফ হোসেন বলেন, ‘শহরের প্রায় সব এলাকাতেই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। শিশুরা শব্দ দূষণে বেশি ভুক্তভোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের শ্রবণ শক্তি লোপ পেয়েছে, যার মধ্যে ২৬ শতাংশই হচ্ছে শিশু। এলাকাভিত্তিক কমিটি করে শব্দ দূষণ রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক বিধান চন্দ্রপাল বলেন, ‘অধিকাংশ শিল্প কারখানা, বড় বড় প্রতিষ্ঠান ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে শব্দ দূষণ প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের বিকেন্দ্রীকরণের ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে। শিশুদের সঠিক বিকাশে শব্দ দূষণই প্রধান বাধা।’