রাজনৈতিক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ধরন বদলেছে। প্রতিহিংসার রাজনীতি ও আধিপত্যের লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত হতাহত হচ্ছে বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। নিজ নিজ দল ছাড়াও আগে বেশিরভাগ আধিপত্যের লড়াইয়ে হতাহত হতো দু’টি বিপরীত দলের মধ্যে। তবে অন্তঃদলীয় কোন্দলে সেই লড়াই এখন বেশি হচ্ছে নিজেদের মধ্যে। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই সহিংসতা আরও বাড়ছে। যেসব মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থা এসবের তথ্য রাখে, তাদের তথ্যেও দেখা যায়, বেশিরভাগ রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে নিজেদের মধ্যে। অপরাধ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশে চলছে দুর্বৃত্ত্বায়ন। আদর্শের কোনও রাজনীতি নেই। যে কারণে প্রতিপক্ষ দল ছাড়াও নিজ দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত ও খুনোখুনি হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে ময়মনসিংহের যুবলীগ নেতা মো. সাজ্জাদ আলম ওরফে শেখ আজাদ হত্যাকাণ্ড। গত ৩১ জুলাই ময়মনসিংহ শহরে প্রকাশ্যে তাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি যুবলীগের স্থানীয় নেতা। স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তার ও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ ঘটনায় শেখ আজাদের পরিবার এজাহারে ধর্ম মন্ত্রীর ছেলে মোহিত উর রহমানকেও আসামি করেছেন।
রাজধানীর বাড্ডায় এ বছর তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দলের পদ দখল, ডিশ ব্যবসা, ঝুট ব্যবসা, চাঁদাবাজী ও গরুর হাটের ইজারাসহ বিভিন্ন বিষয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। গত ১৫ জুন দুপুরে জুমার নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাড্ডার পূর্বাঞ্চল-১ নম্বর লেনের বায়তুস সালাম জামে মসজিদের পাশে বাড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। বর্তমানে উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভূক্ত ওই এলাকা। এর আগে গত ৯ মে বাড্ডার আলাতুন্নেসা স্কুলের জাগরণী ক্লাবের মধ্যে খুন হন ডিশ ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক ওরফে ডিশ বাবু। এ হত্যার ঘটনায় বাবুর বাবা ফজলুর রহমান বাদি হয়ে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বাড্ডা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ২২ এপ্রিল বাড্ডার বেরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের ছোটভাই কামরুজ্জামান দুখু প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন। এভাবেই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক খুন হচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। এসব হত্যাকাণ্ডের এখনও তদন্তই শেষ হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রাজনৈতিক সহিংসতায় গত জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৭৮টি ঘটনায় ১৯জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দুই হাজার ৩৮০ জন। এরমধ্যে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে ১৪ জন নিহত হয়েছে। বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে মারা গেছে ৪ জন। গত বছর ২০১৭ সালে ৩৬৪ রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৫২ জন মারা যায়। আহত হয়েছে ৪ হাজার ৮১৬ জন। ২০১৬ সালে ৯০৭টি ঘটনায় ১৭৭ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১১ হাজার ৪৬২ জন। ২০১৫ সালে ৮৬৫ টি ঘটনায় ১৫৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ছয় হাজার ৩১৮ জন। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের বছরে রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৬৬৪টি। এসব ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত এবং আট হাজার ৩৭৩ জন আহত হয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক সংঘাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০১৩ সালে। এ বছর রাজনৈতিক সংঘাতে ৫০৭ জন মারা যায়। আহত হয় ২২ হাজার ৪০৭ জন মানুষ।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আদর্শিক রাজনীতি এক জিনিস। যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি হচ্ছে আদর্শের রাজনীতি। সেই বিষয়টি আলাদা। কিন্তু রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় জমি দখল, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, তাহলে সেটা রাজনীতি হবেনা। সেটা হবে রাজনৈতিক ছদ্মবেশে দুর্বৃত্ত্বায়ন। আমাদের দেশে এখন রাজনৈতিক ছদ্মবেশে দুর্বৃত্ত্বায়ন হচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করি, রাজনীতি হবে নীতির জন্য ও আদর্শের জন্য। রাজনীতি যদি হানাহানির জন্য হয় সেই রাজনীতি প্রত্যাশিত নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘একটি হচ্ছে নিজ দলের মধ্যে বিরোধ, আরেকটি হচ্ছে ভিন্ন দলের মধ্যে বিরোধ। যেমন আওয়ামীলীগ-বিএনপির মধ্যে হানাহানি। আরেকটি হচ্ছে বিএনপির মধ্যে কিংবা আওয়ামীলীগের মধ্যে যখন হয় সেটা অভ্যন্তরীন। আদর্শিক বিষয়টা যখন না থাকে, তখন চাঁদাবাজি, টাকা পয়সার ভাগাভাগি, জমি-জমা, কে কোন পদে যাবে সেটা যখন গনতান্ত্রিকভাবে হয়না তখন হানাহানি হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের বছরে প্রচুর হানাহানি হয়। বিশ্বজিতকে হত্যা করা হয়েছে। এমন অনেক লোক এসব হানাহানির বলি হয়ে যায়।’ অভ্যন্তরীন সংঘাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিজ দলের ভিতরে অভ্যন্তরীণ সংঘাত সবসময় কমবেশি ছিল। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় দেশে ১৩০ জনের মতো মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। আর সেটা হয়েছে পদ পজিশনে যেতে ও মনোনয়নের জন্য। তখন আর্থিক দিকটা কিংবা ভাগ-বাটোয়ারাটা বড় হয়ে যায়। এতেই খুনোখুনি ও হানাহানি বেড়ে যায়।’
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সংঘাতের বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক যে অস্থিরতা এবং সমঝোতাহীন যে রাজনীতি আর সেই আদর্শবিহীন রাজনীতির বহিপ্রকাশ হচ্ছে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ ও এক দলের সঙ্গে আরেক দলের মারামারি ও সংঘাত। নিজেদের মধ্যে সংঘাত বেড়ে যাওযার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আধিপত্য বিস্তার, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা ও আদর্শ বর্জিত রাজনীতির চর্চার কারণেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়ে যাচ্ছে। নিজ রাজনৈতিক দলের ভেতরে এ প্রতিযোগিতা চলবে। যেহেতু রাজনীতিটা আদর্শবিহীন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতা নাই, স্বচ্ছতা নাই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এগুলো নাই। এ কারণেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।
নূর খান লিটন আরও বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন অভিযানের নামে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রতিনিয়ত মানুষ হত্যা হচ্ছে। স্বজন ও পরিবারগুলোর দাবি অনুযায়ী মনে হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা গুমের সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সবকিছুর একটি লক্ষ্য আছে, সেটি হচ্ছে সমাজে একটি ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর সমাজে ভয়ার্ত পরিবেশ প্রবাহমান থাকা অবস্থায় নির্বাচনে মানুষের স্বাধীন মতামত প্রকাশের বিষয়টি সীমিত হয়ে যায়। তারপর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভাড়া করে মানুষ খুন ও গুমের বড় নজির হচ্ছে নারায়নগঞ্জের সাত খুন। আরও অনেক গুম খুনের রহস্য যদি আমরা উন্মোচিত করতে পারতাম বা ভবিষ্যতে যদি পারি তাহলে এ ধরনের অনেক ঘটনা বেরিয়ে আসবে।’