X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘বড়াল-হালদা-সারি-ধলেশ্বরী রক্ষায় আন্দোলন চলবে’

সঞ্চিতা সীতু
১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:১২আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:১৯

মিজানুর রহমান, মঞ্জুরুল কিবরিয়া ও আব্দুল হাই হাদি

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে দেশে নদীর সংখ্যা ৮০০। কিন্তু,এসব নদী এক এক করে মরতে বসেছে। নদীর বুকে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে আমরাই একে একে হত্যা করছি। এই নিষ্ঠুরতার মধ্যেও কিছু কিছু মানুষ রয়েছেন— যারা নদীকে বাঁচানোর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।  যদিও কেউ শুনছেন না তাদের আর্তনাদ, এরপরও এই নদীপাগল মানুষেরা নদীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

নদী কমিশনের সদস্য মো. আলাউদ্দিন বলেছেন, সারাদেশে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, যারা নদীপাগল। এরা মানুষকে জাগিয়ে তুলে নদীকে বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছেন। তিনি আশা করেন, অনেক মানুষের মধ্যে যখন এদের চিন্তা সঞ্চারিত হবে, তখনই বেঁচে যাবে নদীর প্রাণ। এরমধ্যে হালদা নদী, বড়াল নদী, ধলেশ্বরী, সারি নদীর দখল নিয়ে যারা কাজ করছেন,তাদের কথা উল্লেখযোগ্য।

চার জেলার বুক চিরে প্রবাহিত প্রমত্তা নদী বড়াল জলহীন এক মরা খালে পরিণত হয়েছে মাত্র ২৫ বছরে। একটি নদীকে মেরে ফেলতে ২৫ বছরে যা যা করা দরকার, তার সব কিছুই করা হয়েছে সরকারি সিদ্ধান্তে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়ে যার শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। আর ২০১০ সালে এসে বড়াল পরিণত হয়েছে নদী থেকে খালে।

বড়াল নদীর বর্তমান অবস্থা

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৮৫ সালে বড়ালের উৎপত্তি স্থল রাজশাহীর চারঘাটে বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অপরিকল্পিত এই বাঁধ নির্মাণের ফলে বড়ালে জলপ্রবাহ কমে যেতে থাকে। এভাবে শুরু হয় বড়ালের মৃত্যুযাত্রা। এরপর চাষাবাদের জন্য পানি পেতে দুটি স্লুইসগেট আর তিনটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য মতে, বড়ালের উৎসস্থল চারঘাটে একটি, সেখান থেকে ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে আটঘড়িতে আরেকটি এবং আরও ১২৫ কিলোমিটার ভাটিতে পাবনার চাটমোহরে একটি— অর্থাৎ, বড়ালের ওপরে তিনটি আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। দহপাড়ায় রয়েছে আরেকটি স্লুইসগেট। স্লুইসগেটগুলো অচল এবং বন্ধ হয়ে যাওয়াতে পানির প্রবাহ একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এক পর্যায়ে স্থানীয়দের আন্দোলনের মুখে বাঁধ অপসারণ করে প্রশাসন। কিন্তু মৃত্যু ঠেকানো যায়নি বড়াল নদীর— এসব কথা জানালেন মিজানুর রহমান, যিনি বড়ালকে বাঁচাতে পাগলপ্রায় একজন মানুষ।

নদীপ্রেমী মিজানুর রহমান বলেন,‘বড়াল নদীর পারেই আমার জন্ম। এই নদীতেই সকালে গোসল করে স্কুলে গেছি, এই নদীতে মাছ ধরেছি, এই নদী আমার জীবনের অংশ। নদীর পারেই আমার বাড়ি। আশির দশকে চারঘাটে স্লুইস গেট দিলো । নদীটা ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি পদ্মা থেকে উৎপত্তি হয়েছে এবং যমুনায় গিয়ে মিশেছে। চলন বিলের মাঝখান দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হচ্ছে। স্লুইস গেটের কারণে ৫০০/৬০০ ফিট চওড়া নদী হয়ে গেলো খাল। ৩০ ফিট চওড়া করে ৮ ফিট উঁচু স্লুইস গেট দেওয়া হলো। এতে করে ভাটিতে পানি শুন্য হয়ে পড়েছে। প্রথম দিকে বিষয়টি বোঝা যায়নি। পরে ধীরে ধীরে পানির প্রবাহ কমতে শুরু করলো। এরপর টুকটাক আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু সংগঠিত না হওয়ায় আন্দোলন দাঁড়াচ্ছিল না। এরপর নিজেরাই সংগঠিত করার উদ্যোগ নিই।’ তিনি বলেন, ‘শুধু বড়াল নদী নয়, চলনবিল বাঁচানোও আমাদের আন্দোলনের মূল কাজ।’

হালদা নদীর দখল ও  দূষণ নিয়ে কাজ করেন মঞ্জুরুল কিবরিয়া। ফটিকছড়িতে হালদা নদীর পাড়েই বাড়ি মঞ্জুরুল কিবরিয়ার। তিনি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী,তখন থেকেই নদীর দখল আর দূষণ নিয়ে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি তিনি।

শিল্প বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে হালদার পানি বাংলাদেশের সব থেকে পরিচিত নদীগুলোর একটি  হালদার আজ করুণ দশা। দেশের সব থেকে বড় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র এই হালদা মাছেরও অভায়শ্রম।  মা মাছের ডিম ছাড়ার সময় হালদায় নামে লাখ লাখ জেলে। কিন্তু এই নদীটিকেও দূষিত করতে আমরা কার্পণ্য করিনি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন হালদার বর্জ্য ঢালছে। রাবার ড্যাম দিয়ে হালদার প্রবাহেও বাঁধা দিয়েছে এলজিআরডি। এসব কিছুর বিরুদ্ধে দুর্বার  প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন চট্টগ্রামের এক দল পরিবেশ সচেতন মানুষ,  যার নেতৃত্বে রয়েছেন মঞ্জুরুল কিবরিয়া।

নদী বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ২০০১ সালে হালদা নিয়ে কাজ শুরু করেন কিবরিয়া। ‘এটি শুধু গবেষণার বিষয় নয়, এই নদীকে বাঁচাতে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার’ বলেন মঞ্জুরুল কিবরিয়া।

তিনি জানান, এরপর নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে ২০০৭ সালে নদী বাঁচাতে সরকারি প্রকল্প নেওয়া হলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। প্রকল্পের সঙ্গে হালদার সমস্যার সঙ্গে কোনও মিল নেই। যারা প্রকল্প তৈরি করেছেন,তারা কেউ হালদা নদী দেখেনি পর্যন্ত। এরপর আমরা সামাজিক যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করলাম। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আন্দোলন চলছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে বড় কোনও পরিবর্তন আসেনি। তিনি আরও  জানান, নদীতে রাবার ড্যাম দিয়েছে এলজিআরডি,হালদায় মাছ চাষ প্রকল্প নিয়েছে মৎস্য অধিদফতর, নদী থেকে পানি তুলে নিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কিন্তু এদের কারও সঙ্গে কারোর সমন্বয় নেই। আবার নদীতে বর্জ্য ফেলছে সিটি করপোরেশন। এসব বিষয়ে সুপারিশ  তৈরি করে আমরা সবগুলো বিভাগেই দিয়েছি। নদী কমিশনেও দিয়েছি।

হালদায় মাছ ধরছেন জেলেরা মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘হালদা হচ্ছে বাংলাদেশের পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার একটি নদী। অন্যসব নদীর উৎপত্তিস্থল প্রতিবেশী দেশে। ফলে চেষ্টা করলেই হালদাকে বাংলাদেশের মডেল নদী বানানো সম্ভব। সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নদীটি বাঁচানো সম্ভব।’  

হালদার মতোই করুণ দশা ধলেশ্বরীর। টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর দৈর্ঘ ২৯২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৪৪ মিটার। এত বড় দীর্ঘ এই নদীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। টাঙ্গাইল এবং মানিকগঞ্জ অংশের অবস্থা আরও খারাপ। কিন্তু ধলেশ্বরীকে বাঁচানোর আন্দোলন যতই বেগবান হোক না কেন, কেউই কানে নিচ্ছেন না নদী বাঁচানোর দাবিদাওয়া, বললেন অ্যাডভোকেট আরজু। ধলেশ্বরী বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি।

অ্যাডভোকেট আরজু জানান, একসময় ধলেশ্বরী বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী ছিল। এখন কোথাও কোথাও সেই নদীর চিহ্নও নেই। নদীটির বাঁকে বাঁকে শিল্প-কারখানা থেকে বর্জ্য ফেলে  ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ধলেশ্বরীর বুকে চর পড়েছে। নদীটি টাঙ্গাইল থেকে মানিগঞ্জ হয়ে পদ্মায় গিয়ে পড়েছে। আমরা এই নদীকে বাঁচাতে  দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। আমাদের আন্দোলনের ফলে নদী খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দখল, দূষণ আর ভরাট তিনটাই হচ্ছে এই নদীতে। নদী কমিশনের সদস্যরাও ধলেশ্বরী দেখে গেছেন। কিন্তু কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শুধু আলোচনাই হচ্ছে।’

ধলেশ্বরী বাঁচাও আন্দোলনের নেতা আরজু বলেন, ‘নদী যেখানে যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। কিন্তু উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে, সিএস খতিয়ান অনুযায়ী নদী উদ্ধার করা। সেটি করতে হলে অনেক মানুষের বাড়িঘর ভেঙে ফেলতে হবে। কারণ, নদী দীর্ঘ সময়ে তার অবস্থানের পরিবর্তন করেছে। যেহেতু বাড়িঘর থেকে মানুষকে   উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়, তাই কোনও কাজই করা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘এখন নদীটি যেখানে আছে— সেখানেই এর নাব্য রক্ষা করা দরকার। দূষণ বন্ধে নেওয়া দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। নদীর কিছু কিছু জায়গায় ড্রেজিং করা হলেও তা কার্যকর নয়।

সারি নদী বাঁচানোর দাবিতে মানববন্ধন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রাণ ভোমড়া সারি নদী। ভারতের মেঘালয় মাইনথ্রু পাহাড় থেকে সারি নদীর উৎপত্তিস্থল। সেখান থেকে সিলেটের গোয়াইনঘাট হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এই নদী। ছাতকের কাছে সুরমার এসে পড়েছে সারি। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় থেকে বালু আর নুড়ি পাথর ভেসে আসে সারির প্রবাহে। শীতের শুরু থেকে এ নদীর পানি নীলাভ হতে শুরু করে। নদীর তলার বালুকণাও খালি চোখে দেখা যায়। এমন স্বচ্ছ স্ফটিক পানির নদী বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই।  সেই সারির ওপর বাঁধ দিয়ে মেঘালয় রাজ্য সরকার জল বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে চাইলে আন্দোলনে নামেন সিলেটের মানুষেরা। সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন আব্দুল হাই হাদি। তিনি এখন সারি নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি।

আব্দুল হাই হাদি বলছিলেন দীর্ঘ সেই আন্দোলনের কথা— ‘২০১২ সালে শুরু হয় এই আন্দোলন। স্মারকলিপি দিলাম, যাতে এক তরফা কিছু না করা হয়। যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে আমাদের দাবি ভারত সরকারের কাছেও পৌঁছে যায়। দুদেশের পরিবেশবাদীরা এই নদী বাঁচাতে আন্দোলন করছে এখনও পর্যন্ত। যতদিন না এই নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত না হবে, পানির ন্যার্য হিস্যা থেকে যাতে আমরা বঞ্চিত না হই, ততদিন এ আন্দোলন চলবে।

 

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছেলেবেলার ক্লাবের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন রোনালদো
ছেলেবেলার ক্লাবের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন রোনালদো
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর, আ.লীগ নেতার ভাগনে কারাগারে
মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর, আ.লীগ নেতার ভাগনে কারাগারে
ইন্দোনেশিয়ার রুয়াং আগ্নেয়গিরিতে আবারও অগ্ন্যুৎপাত,সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি
ইন্দোনেশিয়ার রুয়াং আগ্নেয়গিরিতে আবারও অগ্ন্যুৎপাত,সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি
সর্বাধিক পঠিত
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়