সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়লেও অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই করোনা পরিস্থিতিতেও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফিজিক্যাল ও কঠোর সাইবার পেট্রোলিংয়ের কারণে চূড়ান্ত পরিকল্পনার আগেই ধরা পড়ে যাচ্ছে তারা। আগে যেভাবে একটা আস্তানা নিয়ে ট্রেনিং দিতো, আমির থাকতো, অপারেশন প্ল্যান ও অস্ত্র সংগ্রহ করতো, এখন সেই অবস্থায় নেই জঙ্গিরা। সামনে আসার মতো শক্তি জঙ্গিদের নেই বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
পুলিশসহ দেশের সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের বিশেষ সংস্থা অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ), ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), পুলিশ সদর দফতর, জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম শাখা, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর (ডিজিএফআই) একযোগে অনলাইনে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় জঙ্গিবাদের প্রোপাগান্ডা ও কার্যক্রম বন্ধের জন্য কাজ করছে। তারপরও জঙ্গিরা থেমে নেই।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গিরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া জঙ্গিদের কার্যক্রম ও কৌশলও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রপ্ত করেছে। অনলাইন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সাইবার পেট্রোলিং থাকায় জঙ্গিরা বড় কোনও কার্যক্রমে সফল হতে পারছে না। তবে তারা বসেও নেই। তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব কার্যক্রম চালাতে পৃষ্ঠপোষক লাগে। সাম্প্রতিক সময়ে সেই পৃষ্ঠপোষক তারা পাচ্ছে বলে মনে হয় না। পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এ ধরনের সংগঠন টিকে থাকতেও পারে না। আমাদের ভূ-রাজনৈতিক কারণেই সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। না হয় সুযোগ পেলেই তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।’
পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখা ও ল-ফুল ইন্টারসেপশন সেলে (এলআইসি) থেকে সারাদেশে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন মো. মনিরুজ্জামান। বর্তমানে তিনি অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের জঙ্গি পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতেও আমাদের অভিযান চলছে। দেশের সব বিভাগেই অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট অভিযান চালিয়েছে। আবার অনেক জঙ্গি সংগঠন ভেতরে ভেতরে অনলাইনে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে সংগঠিত হওয়ারও চেষ্টা করছে। তবে সামনে আসার মতো শক্তি তাদের আছে বলে মনে করি না। আমাদের কার্যক্রমও এখন অনেক বেশি। চেষ্টা করছি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।’
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘জঙ্গিদের প্রকাশ্য যে রূপটা ছিল, সেটা এখন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। তারপরও সংগঠিত হওয়ারও চেষ্টা করছে তারা। আমাদের সাইবার পেট্রোলিংটা পুরোপুরি চালু থাকায় তারা সফল হতে পারছে না।’ তিনি জানান, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ৩৪টি মামলা করেছে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট। বাংলাদেশের আটটি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনসহ সব জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়েছে। কালো তালিকাভুক্ত আছে আরও অন্তত সাতটি উগ্রবাদী সংগঠন। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ কিংবা জড়িত আরও প্রায় দেড় হাজার জনের প্রোপাইল তৈরি করা হয়েছে। এরমধ্যে জঙ্গি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও পলাতক জঙ্গিরাও আছে।
দীর্ঘদিন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের (এসএজি) ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন। হলি আর্টিজানসহ জঙ্গিবিরোধী বড় বড় অভিযানে ফ্রন্ট ফাইটার হিসেবে সফল ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের অর্গানাইজড ক্রাইমের পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশে জঙ্গি পরিস্থিতির কী অবস্থা, কিংবা করোনাকালের সুযোগে জঙ্গিরা আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে কিনা জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। আগে যেভাবে দেশে জঙ্গিবাদের সাংগঠনিক কাঠামো ছিল, বর্তমানে সেই সাংগঠনিক কাঠামো আর নেই।’
সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘অর্গানাইজড কাঠামোতে জঙ্গিরা আগে যেভাবে ট্রেনিং, রিক্রুটমেন্ট, অপারেশন প্ল্যান এবং অস্ত্র সংগ্রহ করতো, সেই অবস্থাতে তারা একেবারেই নেই। অব্যাহত অভিযান ও নজরদারির কারণে তারা দুর্বল হয়ে গেছে। নতুন করে লিডারশিপও গড়ে তুলতে পারছে না। রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া যদি সচল না থাকে, ফিজিক্যালি যদি কন্টাক্ট করতে না পারে, তাহলে লিডারশিপটাও ডেভেলপ করে না। তবে এই অবস্থাতেও তারা যে চেষ্টাটা করে, সেটা হচ্ছে—অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে কাউকে উদ্বুদ্ধ করে, স্থানীয়ভাবে কোনও ধরনের কিছু করা যায় কিনা। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও কোনও পরিকল্পনা নেওয়ার আগেই আমরা সাইবার পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে অনেককে গ্রেফতার করেছি। ফলে জঙ্গিদের কার্যক্রম পরিচালনা করাটা এখন বাংলাদেশে কষ্টকর হয়ে গেছে। কারণ, আমাদের একাধিক ডেডিকেটেড ইউনিট ফিজিক্যাল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের পেছনে লেগে আছে।’
গত ৪ জুলাই কথিত হিজরতের নামে রাজধানী থেকে ঘর ছেড়েছিল সাফফাত নামের এক কিশোর। দেড় মাস চাঁদপুরে থেকে ঢাকায় ফিরে এলে গত ১৭ আগস্ট সদরঘাট এলাকা থেকে ইয়াছির আরাফাত শান্তসহ সাফফাতকে গ্রেফতার করা হয়। জঙ্গিবাদে দীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়াও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছে সাফফাত। জঙ্গিদের এসব তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘কিছু তো তারা চেষ্টা করছেই। কিন্তু আগে যেভাবে একটা আস্তানা গেড়ে সেখানে ট্রেনিং দিতো, আমির থাকতো, অপারেশন প্ল্যান ও অস্ত্র সংগ্রহ করতো—এসব আর আগের মতো নেই। একেবারেই ভঙ্গুর অবস্থায় আছে তারা। শুরুতে কিংবা মাঝপথেই কোনও পরিকল্পনা নেওয়ার আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে তারা।’ তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি কিশোর-তরুণরা কী করছে, ইন্টারনেট ব্যবহার কীভাবে করছে, সেগুলোতে অভিভাবকদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। তাহলেই কেবল জঙ্গিবাদের বিষবৃক্ষটি সমূলে উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে।’