X
শনিবার, ১১ মে ২০২৪
২৮ বৈশাখ ১৪৩১
জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি পর্ব-৩

ঋণগ্রহীতার গুদামেই জামানত, খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে আবার ঋণ!

শাহেদ শফিক
০৫ আগস্ট ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২১, ১০:১৬

ব্যাংকিং খ্যাতের নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ ও অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।

নীতিমালা ভেঙে এমকেট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে শত কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংকের যশোরের এম কে রোড করপোরেট শাখা। এতে প্রতিষ্ঠানটির ৬৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের যোজসাজশেই এ অনিয়ম ঘটেছে। সরকারের একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বাংলা ট্রিবিউনের কাছে পৌঁছা একাধিক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

তাতে দেখা গেছে, ক্যাশ ক্রেডিট হাইপোথিকেশন-এর (সিসি হাইপ) বিপরীতে কোনও মালামাল নেই। এ ছাড়া লোন এগেইনস্ট ইমপোর্ট মার্চেন্ডাইজ (লিম) ঋণের বিপরীতে মালামাল গোডাউনে না রেখে আত্মসাৎ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্লেজ মালামালের গুণগত মান নষ্ট হওয়াতেও ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে।

নিরীক্ষায় ব্যাংকটির ঋণ সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ মালের ১৮ আগস্টের স্টক রিপোর্ট অনুযায়ী ৯৫টি লিমের বিপরীতে আমদানিকৃত মালামাল গোডাউনে নেই। পণ্য বিক্রির টাকা গ্রাহক ঋণ হিসাবে জমা না করে আত্মসাৎ করেছে। এতে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি ২১ লাখ টাকা।

আরও দেখা গেছে, স্টক রিপোর্ট অনুযায়ী সাত কোটি টাকার ঋণসীমার বিপরীতেও কোনও জামানত নেই। জামানতের মালামাল গ্রাহক বিক্রি করে দিয়েছেন।

গ্রাহকের অনুকূলে ১৫ কোটি টাকার সিসি (প্লেজ) ঋণের বিপরীতে সরবরাহকৃত ১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকার মালামালের মধ্যে ১২ কোটি ৯২ লাখ টাকা মূল্যের টিএসপি এবং এমওপি সার ২০১১ ও ২০১২ সালে মজুতকৃত বলে এর গুণগত মান নষ্ট হয়। সবমিলিয়ে তিনটি ঋণ বাবদ গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের মোট পাওনা প্রায় সাড়ে ৬৬ কোটি টাকা। এরপরও এমকেট্রেড ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি ব্যাংক।

আরও দেখা যায়, গুদামে মালামাল না থাকার পরও ওই গ্রাহককে ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। প্রধান কার্যালয় ও আঞ্চলিক কার্যালয় বিষয়টি জেনেও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো প্রতিবছর প্লেজ ঋণ নবায়ন করেছে।

নথিতে আরও বলা হয়েছে, আমদানিকৃত মালামাল ব্যাংকের গুদামে না রেখে শাখার কর্মকর্তারা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।

জবাবে জনতা ব্যাংক বলেছে, ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পর্ষদের ৪৬০তম সভায় অনুমোদন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৭ সালের ২ মার্চের অনাপত্তিক্রমে ৪৮টি কিস্তিতে পরিশোধের শর্তে গ্রাহকের লিম দায় পুনঃতফসিল করা হয়।

গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ না করায় ঋণটি বিএল শ্রেণিকৃত হয়। সিসি (হাঃ) ঋণের মালামালের মালিকানা যেহেতু গ্রাহকের, তাই মালিক তা বিক্রি করে দেয়। গ্রাহকের প্লেজ গুদামে রক্ষিত মালামাল বিক্রি করে ঋণ হিসাবে জমা করা হয়।

ব্যাংকটির এমন জবাবে সন্তুষ্ট নয় নিরীক্ষা দল। তারা জানায়, মালামাল আত্মসাতের জন্য গ্রাহকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের না করে পুনঃতফসিল করা ঠিক হয়নি। এমনকি দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

সিক্স সিজনসের কাছে ২০০ কোটি
অধিগ্রহণকৃত ঋণ বারবার পুনঃতফসিলের সুবিধা দিয়েও মেসার্স সিক্স সিজনস অ্যাপার্টমেন্ট লিমিটেডকে দেওয়া ঋণের প্রায় দুই শ’ কোটি টাকা আদায় করা যায়নি। দায়ের তুলনায় জামানত কম হওয়ায় এতে ব্যাংকটির ক্ষতি হয়েছে ১৯৭ কোটি ২১ লাখ টাকারও বেশি।

ওই প্রতিষ্ঠান ২০১৩ সালের ১৯ অক্টোবর হতে ব্যবসা শুরু করলেও নিরীক্ষার সময় পর্যন্ত গ্রাহক কোনও টাকা পরিশোধ করেনি।

২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর ২৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার পরিবর্তে নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট ৩০ লাখ টাকা দিয়ে দ্বিতীয়দফায় ঋণ পুনঃতফসিলি করা হয়। এরপরও গ্রাহকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

জনতা ব্যাংক বলেছে, সিক্স সিজনস অ্যাপার্টমেন্ট লিমিটেডের অনুকূলে সকল নিয়ম মেনে ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। ঋণ আদায়ের ব্যাপারে গ্রাহকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জবাব গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ গ্রাহকের ব্যবসার অভিজ্ঞতা ও আর্থিক সামর্থ্য যাচাই না করে বাববার পুনঃতফসিল করে কালক্ষেপণ করা এবং ঋণের দায় বাড়ানো আইনসম্মত নয়।

খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে আবারও ঋণ!
‘স্বভাবগত খেলাপি’ গ্রাহক মেসার্স লিতুন ফেব্রিক্স লিমিটেডকে বারবার পুনঃতফসিল দিয়ে ঋণ মঞ্জুর করেছে জনতা ব্যাংক। এতে ব্যাংকটির প্রায় ৭২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।

লিতুন ফেব্রিক্সের ঋণের নথি নিরীক্ষা করে দেখা যায়, ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পর্ষদের ৭৬৫তম সভায় ওই গ্রাহকের অনুকূলে ১৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা প্রকল্প ঋণ এবং ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ৫ কোটি টাকা সিসি (হাঃ) ঋণ মঞ্জুর করে পরে সাত কোটি টাকায় বর্ধিত করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১২ সালের সার্কুলার অনুযায়ী ঋণ পুনঃতফসিলের পর নতুন ঋণ পেতে হলে বিদ্যমান স্থিতির ১৫ শতাংশ কম্প্রোমাইজড এমাউন্ট গ্রহণ ছাড়াই ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর  বিএমআরই ঋণ বাবদ ৩৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়। যা ঋণ মঞ্জুরি ক্ষমতা বিধির পরিপন্থী। তদুপরি কম্প্রোমাইজড এমাউন্ট ৩৩ দশমিক ৮৮১ কোটি টাকার পরিবর্তে মাত্র দুই কোটি টাকা আদায় করা হয়।

ঋণ মঞ্জুরের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি না নিয়ে এবং বন্ধকিকৃত সম্পত্তির দলিলায়ন না করে ব্যাংকের এমডির নির্দেশনায় ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর পাঁচ কোটি টাকা এবং একই বছরের ১ ডিসেম্বর আট কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। বিতরণকৃত ঋণের দায়ভার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এড়াতে পারেন না বলেও নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

জনতা ব্যাংক বলেছে, গ্রাহকের আবেদন, ক্রেডিট কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পর্ষদে লিতুন ফেব্রিক্স লিমিটেডের অনুকূলে ডাউনপেমেন্ট ও কম্প্রোমাইজড এমাউন্ট গ্রহণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি গ্রহণ সাপেক্ষে ঋণ মঞ্জুর করা হয়।

পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধি ও নীতি বিভাগ বিশেষ বিবেচনায় নিতুন ফেব্রিক্সের অনুকূলে নতুন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কম্প্রোমাইজড এমাউন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেয়। এক্সিট পলিসির আওতায় সুদ মওকুফের জন্য আবেদন করেছে গ্রাহক, যা প্রক্রিয়াধীন।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি গ্রহণ করা হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে কোনও মন্তব্য দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে তারও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রায় ১৬ মাস পার হলেও ঋণের অর্থ আদায়ের অগ্রগতি সম্পর্কে নিরীক্ষাকে জানায়নি ব্যাংক।

অনিয়মগুলোর বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর অগ্রিম অনুচ্ছেদ জারি করা হয় এবং তাগিদপত্র দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ সচিব বরাবর আধাসরকারি পত্র দেওয়া হলেও জবাব পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কথা বলতে পারবো না।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অডিট অধিদফতর এই অভিযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও নিজস্ব অডিট উইং রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন কোনও ব্যাংকে অডিটে যায় তখন এক্সটারনাল-ইন্টারনাল অডিট সব দেখে। এরপর পদক্ষেপ নেয়।’

/এফএ/
টাইমলাইন: জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি
০৫ আগস্ট ২০২১, ১৫:০০
ঋণগ্রহীতার গুদামেই জামানত, খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে আবার ঋণ!
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফলন বেশি, চরাঞ্চলের কৃষকরা ঝুঁকছেন ‘জাপানি মিষ্টি আলু’ চাষে
ফলন বেশি, চরাঞ্চলের কৃষকরা ঝুঁকছেন ‘জাপানি মিষ্টি আলু’ চাষে
তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দিলে কেন্দ্রে যেতে নিষেধ কাদের মির্জার
উপজেলা নির্বাচনতার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দিলে কেন্দ্রে যেতে নিষেধ কাদের মির্জার
টিভিতে আজকের খেলা (১১ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১১ মে, ২০২৪)
কালীগঞ্জে জামানত হারিয়েছেন ৪ চেয়ারম্যান প্রার্থী
উপজেলা নির্বাচনকালীগঞ্জে জামানত হারিয়েছেন ৪ চেয়ারম্যান প্রার্থী
সর্বাধিক পঠিত
ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনায় জিডি নয়, মামলা নেওয়ার নির্দেশ
ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনায় জিডি নয়, মামলা নেওয়ার নির্দেশ
২০ মিনিটে লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর, চলবে না অটোরিকশা-বাইক
২০ মিনিটে লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর, চলবে না অটোরিকশা-বাইক
সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার, তুলছেন ভ্রমণ বিলও
সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার, তুলছেন ভ্রমণ বিলও
একই গ্রাম থেকে নির্বাচিত হলেন তিন চেয়ারম্যান
একই গ্রাম থেকে নির্বাচিত হলেন তিন চেয়ারম্যান
প্রশ্নফাঁস: বিমানের ডিজিএমসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র
প্রশ্নফাঁস: বিমানের ডিজিএমসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র