আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে দুই কিস্তির অর্থ ১৩৪ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২৬ জুন বাংলাদেশের হিসাবে এই অর্থ জমা হয়েছে। এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি।
এর ফলে সোমবার (৩০ জুন) পর্যন্ত দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মানদণ্ড ‘ব্যালান্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল সিক্সথ এডিশন (বিপিএম৬)’ অনুসারে হিসাব করলে রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। মঙ্গলবার (১ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ
দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় পর আইএমএফের নির্ধারিত ব্যয়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ বা এনআইআর) লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে বাংলাদেশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আইএমএফ যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তার চেয়ে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বেশি রিজার্ভ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, ৩০ জুন পর্যন্ত আইএমএফের নির্ধারিত এনআইআর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে সেই সময়ে এনআইআর দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে—যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার বেশি।
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পর আইএমএফের দেওয়া রিজার্ভের লক্ষ্য অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এটি সরকারের আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণে নেওয়া নীতিগত ও কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলোর ফল।’
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় প্রতি তিন মাস অন্তর নির্ধারণ করা হয় এনআইআর-এর লক্ষ্য। গত ডিসেম্বর মাসে এই লক্ষ্য ছিল ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা চলতি বছরের মার্চে বাড়িয়ে ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়। জুনের শুরুতে তা আরও বাড়িয়ে ২০ দশমিক ১১ বিলিয়নে উন্নীত করা হলেও পরে পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে তা কমিয়ে ১৭ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নির্ধারণ করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, এনআইআর লক্ষ্য পূরণ করা আইএমএফের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত ইতিবাচক সংকেত। এর মাধ্যমে বৈদেশিক খাতে স্থিতিশীলতা আরও জোরালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। রিজার্ভ বাড়ায় আমদানি ব্যয় পরিশোধে চাপ কমেছে এবং ব্যাংকগুলো সহজে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে।
বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার ১২৩ টাকায় স্থিতিশীল, এর ফলে আমদানি স্বাভাবিক ও মূল্যস্ফীতিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলার ৮৫ থেকে ১২৮ টাকা হয়ে যাওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছিল। তবে সরকার পরিবর্তনের পর প্রবাসী আয় বাড়াতে নেওয়া পদক্ষেপগুলো হুন্ডি কমিয়ে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়িয়েছে, যা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
আগের সরকারের আমলে রিজার্ভ কত ছিল?
২০২৪ সালের ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সপ্তাহে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ ছিল ২৫.৯২ বিলিয়ন ডলার, আর আইএমএফের মানদণ্ড বিপিএম৬ অনুযায়ী ছিল ২০.৪৮ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘটে এবং ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়।
সরকার পরিবর্তনের দিন, অর্থাৎ ৮ আগস্ট রিজার্ভ ছিল ২৫.৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিএম৬ অনুযায়ী ২০.৪৭ বিলিয়ন ডলার।
২০২১ সালের সর্বোচ্চ রিজার্ভ ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ধারাবাহিক পতনে এই পর্যায়ে পৌঁছায়, যার পেছনে ছিল বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও অভ্যন্তরীণ দুর্বল ব্যবস্থাপনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সাল থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১.৩ বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমেছে। ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর এটি সর্বনিম্ন ২৪.১৯ বিলিয়নে নামে, আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী তা ছিল মাত্র ১৮.৪৬ বিলিয়ন ডলার।
২০২৪ সালের এপ্রিলে রিজার্ভ তলানিতে চলে যায়
আওয়ামী লীগ আমলে তথা ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানিতে পৌঁছায়। ওই সময় ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ ছিল মাত্র ১২.৮ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০২৩ সালের জুনে তা ছিল ১৯.৬ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে নেমে আসে ১৬.৭ বিলিয়নে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ ভয়াবহ রেমিট্যান্স সংকটে পড়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বিগত সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলে প্রবাসীরা ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে সমস্যায় পড়েন। আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেল এড়িয়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান।
ফলে ওই মাসে রেমিট্যান্স নামে মাত্র ১৯০ কোটি ডলারে, যা আগের ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগের মাস জুনে রেমিট্যান্স ছিল ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার—অর্থাৎ এক মাসে ৬৩ কোটি ডলার কমে যায়।
ওই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রবাসীদের অনাগ্রহ, হুন্ডির দাপট ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপের মধ্যে গভীর সংকটে পড়ে বাংলাদেশ।
অবশ্য পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পরিবর্তনের পর থেকেই। তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের স্থানে দায়িত্ব নেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি দায়িত্ব নিয়েই কঠোর অবস্থান নেন রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে। দায়িত্ব নিয়েই তিনি বাস্তবমুখী নীতির প্রয়োগ শুরু করেন। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রণোদনা সহজ করে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও মধ্যপ্রাচ্যে রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সমন্বয় জোরদার করা হয়। অক্টোবর থেকে প্রতি ডলারে প্রণোদনা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয় এবং একাধিক মানি ট্রান্সফার কোম্পানির সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় গড়ে তোলা হয়।
পাশাপাশি হুন্ডি রোধে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয়। এসব উদ্যোগের ফলে অক্টোবর থেকেই রেমিট্যান্স বাড়তে শুরু করে। ফেব্রুয়ারিতে তা ২.৫২ বিলিয়ন এবং মার্চে ৩.২৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবাসী আয় বাড়ানো ও আমদানি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া কার্যকর নীতিগুলোই রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। শুধু তাই নয়, তিনি দায়িত্ব নিয়ে ডলার বিক্রি বন্ধ করেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা নেন এবং এলসি নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি ও পুঁজি পণ্যের আমদানি কমিয়ে রিজার্ভ বাঁচান। তিনি ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন, কয়েকটি ব্যাংকের দুর্বল পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেন এবং রেমিট্যান্সে আস্থা ফেরাতে হুন্ডিবিরোধী কার্যক্রম জোরদার করেন।
ফলে রেমিট্যান্স, রফতানি আয় এবং বৈদেশিক সহায়তা বাড়তে থাকে। শুধু প্রথম তিন মাসে রিজার্ভে হাত না দিয়েই ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয়।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইএমএফের কিস্তিসহ বিভিন্ন সংস্থার বৈদেশিক সহায়তা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক হলেও রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য প্রবাসী আয়ই এই মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকর রফতানি উপার্জনের উৎস। এই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে জানা গেছে, ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত এক বছরে বৈধ চ্যানেলে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৩২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) তুলনায় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৩ হাজার ৯১২ মিলিয়ন ডলার।
আমদানি নিয়ন্ত্রণ
রিজার্ভ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো আমদানি ব্যয়ের ধারাবাহিকতা হ্রাস। ২০২৩ সাল থেকে বিলাসপণ্য আমদানি ও এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করে আগের সরকার। নতুন সরকার এসে এলসিতে নজরদারি বাড়ায় এবং জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় পুনর্বিন্যাস করে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমে এবং রিজার্ভ চাপমুক্ত থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ছিল ৮২.৫০ বিলিয়ন ডলার, যা পরের দুই অর্থবছরে কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬৮.৬০ ও ৬৩.২২ বিলিয়ন ডলারে। মূল কারণ ছিল আমদানি নিয়ন্ত্রণনীতি। যেমন- এলসিতে কঠোরতা ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যে নিরুৎসাহ।
ব্যবসায়ীদের জন্য স্বস্তির বার্তা
রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে ডলার সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ডলার সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এতে আমদানিকারকদের জন্য এলসি খোলা আগের চেয়ে সহজ হয়েছে এবং আমদানিও বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৭.২৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪.৬২ শতাংশ বেশি। এ সময়ে ৪৫.৯৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা ৪.০৭ শতাংশ বেশি।
ব্যাংকগুলো এখন আমদানিতে আগ্রহী, কারণ রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়ার ফলে ডলার সরবরাহ তুলনামূলক বেশি। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই আমদানি এলসি খোলা হয়েছে ৬.২৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
অর্থ পরিশোধ বেড়েছে
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে এ খাতে মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৭৮ কোটি ৪৬ লাখ ২০ হাজার ডলার। এর মধ্যে মূল ঋণ ২৩৮ কোটি ৩৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার এবং সুদ ১৪০ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার ডলার পরিশোধ হয়েছে। এটি চলতি অর্থবছরে মোট ছাড়কৃত অর্থের ৬৭ দশমিক ৯১ শতাংশ।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩০৬ কোটি ৮১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। সে হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে বৈদেশিক দেনা পরিশোধ প্রায় ৭১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার বেড়েছে।