X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডাকাতির মামলা কেন নিতে চায় না পুলিশ?

নুরুজ্জামান লাবু
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২২:০৩আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২২:২৪

চাচাতো ভাইকে নিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার উদ্দেশে সাভারের ব্যাংক টাউন এলাকা থেকে বাসে উঠেছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। বাসে ওঠার পরই ডাকাতির কবলে পড়েন তারা। ডাকাত দলের সদস্যরা তাদের মারধর করে নগদ টাকা, মার্কিন ডলার, মোবাইল ফোন ও এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয়। ঘটনাটি গত ৯ জানুয়ারি দিবাগত রাতের। ডাকাতরা বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার পরই তারা সাভার মডেল থানার শরণাপন্ন হন। কিন্তু থানা পুলিশ তাদের অভিযোগ আমলে নেয়নি। সমালোচনার মুখে ঘটনার ২৪ দিন পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি সেই মামলা নিয়েছে সাভার থানা পুলিশ।

গত বছরের ৭ ডিসেম্বর একইভাবেই ডাকাতির কবলে পড়ে রাজধানী পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৭২২৮)। ঢাকার মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন থেকে কালিয়াকৈর যাওয়ার পথে ডাকাত দলের সদস্যরা হাত-পা বেঁধে ধারালো অস্ত্রের মুখে যাত্রী ও বাস স্টাফদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়। ডাকাতরা নেমে যাওয়ার পর চালক জুয়েল ও কয়েকজন যাত্রী কালিয়াকৈর থানায় গেলেও পুলিশ বিষয়টি আমলে নেয়নি। ঘটনাটির প্রায় দুই মাসের মাথায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করতে পেরেছেন বাসচালক জুয়েল। তিনি বলেন, ‘ডাকাতির কবলে পড়ার পর কালিয়াকৈর থানায় গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ নাম-ঠিকানা লিখে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করেনি। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডাকাত সদস্যদের ধরার পর আমাদের আশুলিয়া থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেয়। সেখানে আমি মামলা করেছি।’

টাঙ্গাইলের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শফিকুলের অভিজ্ঞতাও একই। বাসে ডাকাতদের কবলে পড়ে তিনি থানায় গিয়ে মামলা করতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এরপরই তোলপাড় শুরু হলে ডাকাত সদস্যদের ধরতে নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঘটনার ৯ দিনের মাথায় তার মামলা নেয় উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ।

আরিয়ান নামে আরেক ভুক্তভোগী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, গত ৩১ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইল থেকে কালিয়াকৈর আসার পথে বাসে ডাকাতির কবলে পড়েন তিনি। কিন্তু পরদিন তিনি থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ তা আমলে নেয়নি। এমনকি থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের (আইনের ভাষায় দস্যুতা) ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিতে গেলেও মামলা নিতে চায় না থানা পুলিশ। মোবাইল বা মানিব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানা পুলিশ মামলা নেওয়ার বদলে জিডি বা সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দিয়ে থাকে। অনেক সময় ভুক্তভোগীরাও ঝামেলা এড়াতে জিডি করেই চলে আসেন। অথচ দণ্ডবিধি বা পুলিশ প্রবিধানে ঘটনার বর্ণনা অনুযায়ী মামলা বা জিডি নেওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মামলা কেন নিতে চায় না পুলিশ?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশেরই একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা একটি এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন তা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রতি সপ্তাহে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে হয়। ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মামলা হলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক এবং সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য হয়। এ কারণে ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মামলা নিতে চায় না থানা পুলিশ।

ডাকাতি নিয়ে উদ্বেগ, মামলা নেওয়ার নির্দেশ
ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের প্রতিটি ঘটনায় মামলা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, অনেক সময় ঘটনা এক থানা থেকে শুরু হয়ে আরেক থানার এলাকা বা দূরের কোনও থানা এলাকায় গিয়ে শেষ হয়। এমন অবস্থায় থানা পুলিশের মধ্যে মামলা নেওয়া নিয়ে ঠেলাঠেলির প্রবণতা দেখা যায়। এটি দূর করতে ঘটনার শুরু হয়েছে যে এলাকায় সেই এলাকার থানা পুলিশকে মামলা নিতে পুলিশ সদর দফতর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তবে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (ক্রাইম) হায়দার আলী খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলা না নেওয়ার অভিযোগ পুরোপুরি সত্যি নয়। কোনও থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। প্রতিটি থানায় সংশ্লিষ্ট এলাকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে।’

প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানানোর আহ্বান জানান পুলিশ সদর দফতরের এই কর্মকর্তা। তার দাবি, ডাকাতসহ অন্য সব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে বাংলাদেশ পুলিশ সার্বক্ষণিক কাজ করছে। তিনি মনে করেন, মহাসড়কে প্রতিটি বাসে স্কর্ট দেওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ বা যাত্রীরা কোনও ঘটনা আঁচ পেলেই ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে পুলিশের সেবা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, মহাসড়কে বাসে ডাকাতির ক্ষেত্রে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলো বেছে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যরা। বিশেষ করে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল মহাসড়কের এলেঙ্গা, মির্জাপুর, কালিয়াকৈর, কবিরপুর, বাইপাইল, নবীনগর, সাভার, হেমায়েতপুর, গেন্ডা, আশুলিয়া, চন্দ্রা, কোনাবাড়ী, ধামরাই, কামালপুর, মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, কাঁচপুর, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ রুটে ডাকাতি ঘটছে বেশি।

খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, এসব রুটে ডাকাতির ঘটনায় যত রিপোর্ট হয়েছে তার চেয়ে প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি। অনেক সময় ডাকাতরা গ্রেফতারের পর ঘটনার কথা স্বীকার করলেও খোঁজ নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মামলা খুঁজে পাওয়া যায় না।

ঢাকার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাসে ডাকাতির ঘটনায় ইতোমধ্যে ডিটেকশন হয়েছে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য পুলিশ পেট্রোলিং বাড়ানো, ডাকাতদের ডাটাবেজ তৈরিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা না নেওয়া প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ‘মামলা না নেওয়ার কোনও কারণ নেই। মামলা নিতে হবে। আমরা মামলা নিচ্ছি। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদেরও মামলা নিতে বলা হয়েছে।’

ডাকাতি বন্ধে সমন্বিত অভিযান
মহাসড়কে বা বাসে ডাকাতি বন্ধে সমন্বিত অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ডাকাতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ সমন্বয় রেখে কাজ করবে। একইসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করেও ডাকাত সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি বাসে ডাকাতির একাধিক ঘটনায় তোলপাড় হলে পুলিশ সদর দফতর, হাইওয়ে পুলিশ, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয় ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একাধিকবার বৈঠকে বসে ডাকাতি বন্ধে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছে। এগুলোতে উপস্থিত থাকা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান–ডাকাতি বন্ধে তারা প্রতিটি বাসে পুশ বাটন নামে একটি ইলেক্ট্রিক ডিভাইস লাগানোর পরিকল্পনা করছেন, যাতে ডাকাতদের কবলে পড়া বাসটি সহজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শনাক্ত করতে পারে।

একইসঙ্গে বাসগুলোতে জিপিএস লাগানো, আইপি ক্যামেরা বসিয়ে মনিটরিং করা, হাইওয়ে পুলিশের পেট্রোলিং বাড়ানো, দূরপাল্লার বাস ছাড়ার আগে যাত্রীদের ভিডিও করে রাখার কার্যক্রম জোরদার, যাত্রীদের এনআইডি ও মোবাইল নম্বর সংরক্ষণ করা, ডাকাতদের একটি সমন্বিত ডাটাবেস তৈরি করা, বাসের রুট পারমিট চেক করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ডাকাতরা সাধারণত বাস নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বিভিন্ন সড়কে ঘুরে বেড়ায়। এক্ষেত্রে এক রুটের বাস অন্য রুটে দেখলে চেক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা বাংলাদেশ বলেন, ‘ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে ডাকাতির ঘটনায় ডাকাতদের ধরতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহায়তা নিতে বলা হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত ডাকাত সদস্যদের শনাক্ত করার সক্ষমতা রয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের। এজন্য সমন্বিতভাবে কাজ করলে দ্রুত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’

সাতটি ডাকাতির ঘটনা রহস্য উদ্ঘাটন
উত্তরা পশ্চিম থানার একটি মামলাসহ সাভার, আশুলিয়া, মির্জাপুর ও টাঙ্গাইল সদর থানায় দায়ের হওয়া সাতটি ডাকাতির মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোন। টাঙ্গাইলের চিকিৎসক শফিকুল ইসলামের ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ডাকাত চক্রের একাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। ডাকাত দলের একাধিক সদস্য বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাসে ডাকাতি করে বেড়াতো। এরমধ্যে একটি বাসে ডাকাতির সময় দুই তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণও করে বলে গ্রেফতারের পর নিজেরাই স্বীকার করেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘ডাকাতির ঘটনায় একাধিক চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে চার জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আদালতে। এখনও কয়েকজন ডাকাত পলাতক। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে।’

/জেএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
কানাডার ইতিহাসে বৃহত্তম স্বর্ণ ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতার ৬
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় বাধ্যতামূলক অবসরে পুলিশ সুপার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
সর্বশেষ খবর
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?