সদ্যপ্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস। রবিবার (১ মে) দুপুরে তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে দীর্ঘ একটি পোস্ট করেছেন। পোস্টে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আবদুল মুহিতের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প, দেশে ফিরে আসার পর বিভিন্ন সময়ের গল্প এবং আবদুল মুহিত দেশের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরের গল্প।
গত শুক্রবার (৩০ এপ্রিল) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে আবুল মাল আবদুল মুহিত মারা যান। হাসপাতালটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। মৃত্যুকালে আবদুল মুহিতের বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
আবদুল মুহিতের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতিচারণ করে ড. ইউনূস লিখেছেন, ‘মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এটা রেডিওতে শুনে আমরা ন্যাশভিলের ছয় জন বাঙালি তাৎক্ষণিকভাবে একত্রিত হয়ে বাংলাদেশ সিটিজেনস কমিটি গঠন করলাম। প্রত্যেকে ১ হাজার ডলার জমা করে একটা তহবিল বানালাম। আমি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় উচ্চতম ব্যক্তি এনায়েত করিমকে ফোন করলাম। বললাম, আমি ওয়াশিংটনে রওনা হচ্ছি। সবার সঙ্গে আলাপ করে কর্মসূচি তৈরি করতে হবে। তিনি আমাকে উৎসাহ দিলেন চলে আসার জন্য। ৬ হাজার ডলারের তহবিল সঙ্গে নিয়ে পরদিন ওয়াশিংটনে গিয়ে সোজা উঠলাম এনায়েত করিমের বাসায়; যার সঙ্গে কোনও দিন আমার পরিচয় ছিল না।’
‘এরপর ওয়াশিংটনে প্রায় রাতে মুহিত ভাইয়ের বাসায় সবাইকে নিয়ে বসা আমাদের নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়ালো। নানা সংবাদ আদান-প্রদান করা। নানা উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্ক, হাতাহাতি; সবকিছুই এই বৈঠকের অংশ হয়ে দাঁড়ালো। যারা ওয়াশিংটনের লোক তারা সারা দিন তাদের অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমরা ক’জন যারা অন্য শহর থেকে এসেছি তারা সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে কাজ করতে থাকলাম। একদিন মুহিত ভাই বললেন, একটা ওয়্যারলেস সেটের জন্য কিছু টাকার দরকার। আমি ন্যাশভিলের ৬ হাজার ডলার তাঁর হাতে দিয়ে দিলাম।’
ড. ইউনূস লিখেছেন, “পরে আমরা ক’জন আরেকটা দায়িত্ব নিলাম। সেটা হলো- বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোতে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো। মুহিত ভাই আমাদের সঙ্গে দূতাবাসগুলোর পরিচয় করিয়ে দিতেন এবং আমাদের ব্রিফ দিতেন কার কাছে, কীভাবে আমাদের প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে হবে।’
এরপরের অংশে দেশ স্বাধীনের পরে আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেন মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি লিখেছেন, দেশে ফিরে আসার পর আবার মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হলো তাঁরই উদ্যোগে। তিনি আমার কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চান। তিনি সরকারি চাকরিতে বিরক্ত হয়ে গেছেন। বললেন, তিনি আমার কর্মকাণ্ড চাক্ষুষ দেখতে চান। আমি সানন্দে ব্যবস্থা করলাম। তাঁকে নিয়ে পুরো একটা দিন টাঙ্গাইলের হাঁটুভাঙা শাখায় কাটালাম। তাঁর হাজারো প্রশ্নের জবাব দিলাম। ঢাকায় ফেরার পথে অনেক কথা বললেন। তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। আমার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করবেন। সিলেটে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা স্থাপন করবেন।’
এরপর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানতে পেরেছেন ড. ইউনূস। তিনি লিখেছেন, ‘তারপর বোধহয় বিদেশ চলে গেছেন। আবার দেখা হলো ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে। কুমিল্লা অ্যাকাডেমিতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। আমরা দুজনেই সম্মেলনের বক্তা। আগের দিন সন্ধ্যায় অনেক আলাপ হলো। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ নিয়ে আমি একটা কনসেপ্ট পেপার লিখেছিলাম। সেটা তাঁকে দিলাম এবং মুখে সবিস্তারে বুঝালাম।’
সম্মেলনের পরের দিন সকাল বেলায় আমাদের সবার ঢাকায় ফেরার কথা। কিন্তু হঠাৎ সারা দেশে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখ করেছেন, আমরা কুমিল্লায় আটকে গেলাম। দুজনে আরও বহু কথা বলার সুযোগ পেলাম। কারফিউ প্রত্যাহারের পর সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরলাম। পরদিন ঘোষণা শুনলাম মুহিত ভাই নতুন সরকারে অর্থমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছেন। আমি অভিনন্দন জানালাম। তিনি দেখা করার জন্য খবর পাঠালেন। মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে যে এবার গ্রামীণ ব্যাংককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সুযোগ পাবো।
তিনি লিখেছেন, ‘দেখা করলাম, তারপর ঘটনা এগোতে থাকলো। একপর্যায়ে এসে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ জারি হলো। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো, নতুন ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে। আমরা অনুষ্ঠানের জন্য এক পায়ে খাড়া। কিন্তু মন্ত্রণালয় চায় এটা ঢাকায় করতে। আমরা বেঁকে বসলাম। আমরা বললাম গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান গ্রামে হবে। মন্ত্রণালয় কিছুতেই এতে রাজি হবে না। আমি মুহিত ভাইকে ফোন করলাম। তিনি সোৎসাহে বললেন, অবশ্যই এটা গ্রামে হবে এবং আমি সেখানে যাবো।’
১৯৮৩ সালের ৩ অক্টোবর টাঙ্গাইলের জামুর্কী গ্রামে ভূমিহীন মহিলাদের এক বিরাট সমাবেশের মাধ্যমে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে বলে লিখেছেন ড. ইউনূস। তিনি আরও লিখেছেন, ‘তার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বহু আনন্দময়, স্বপ্নময়, গৌরবময় স্মৃতিগুলো স্মরণ করে মুহিত ভাইকে আজ বিদায় জানাচ্ছি। আল্লাহ তাঁর রুহের মাগফেরাত দান করুন।’