বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বিস্তার এক নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। টেলিভিশন, রেডিও, দৈনিক পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইন গণমাধ্যমের উদ্যোক্তারা নতুন স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছিলেন এই খাতে। তার একমাত্র কারণ, মানুষ এখন ক্রমাগত তথ্য চায়। তবে খুব দ্রুত মানুষের চাহিদাও বদলায়। শুধু দ্রুত তথ্য নয়, মানুষ চায় সঠিক ও বিশ্লেষণধর্মী তথ্য। সেই জায়গায় ভূমিকা রাখার স্বপ্ন নিয়েই ২০১৪ সালের ১৩ মে পথচলা শুরু করে বাংলা ট্রিবিউন। আজ বাংলা ট্রিবিউন তার আট বছর পূর্ণ করলো। এটা যেমন আনন্দের, তেমনি সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের জন্য বড় একটা অভিজ্ঞতা। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলা ট্রিবিউন তার কর্মীদের প্রচেষ্টায় এই দুর্গম পথ পার করছে। সত্যি কথা বলতে, একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আট বছর কম সময় নয়, আবার খুব বেশি সময়ও নয়। পাড়ি দিতে হবে আরও বহু পথ, যে পথের শেষ নেই।
হ্যাঁ, এটা ঠিক এখন বাংলাদেশে গণমাধ্যম কঠিন সময় পার করছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সংবাদকর্মীদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৫৪ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ২১ জন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এছাড়া সরকারের তৈরি করা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে আছে বিস্তর সমালোচনা। এই অ্যাক্ট বাংলাদেশের সংবাদকর্মীদের পায়ে শেকল পরিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করবে। তাই এই অ্যাক্ট সংশোধন করা খুব জরুরি। সাংবাদিকতার সংকট যে শুধু বাংলাদেশে তা নয়, বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকরা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। যখন এই লেখাটি লিখছি, তখনও একজন সাংবাদিক হত্যার খবরে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার একজন প্রবীণ সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করেছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। নিহত ওই সাংবাদিকের নাম শিরীন আবু আকলেহ।
যাহোক, আমরা সবাই জানি, ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয়। নতুন এ রোগের সঙ্গে শুধু আমরা কেন, পুরো বিশ্বই ছিল অপরিচিত। এই কঠিন সময়ে সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন, মারাও গেছেন। তবু নির্ভয়ে দেশের মানুষকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। চারদিকে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়াকে রুখে দিতে গণমাধ্যম সবচাইতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। এটা স্বীকার করতেই হবে।
বাংলা ট্রিবিউন করোনার শুরু থেকেই কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে হোম অফিস দিয়েছিল, যা চলমান ছিল ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহ প্রকোপ কমে আসার পর থেকে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে কর্মীদের অফিসে আসা শুরু হয়। আমাদের প্রতিবেদকদের তো আর ঘরে বসে কাজ করা সম্ভব হয়নি। তাদের দৌড়াতে হয়েছে মাঠে। সংবাদ নিয়ে আসার জন্য মাঠের সাংবাদিকতার কোনও বিকল্প নেই।
এটাও সত্য, মহামারির সময়ে ঘরে বসেও যে কাজ করা যায়, তার একটা শিক্ষা বিশ্ব পেয়েছে। আর ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তার একটা পূর্ণচিত্র দেখা গেলো করোনাকালীন। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা সাংবাদিকতা করেছি। কোনও বিষয়ে কারও মন্তব্য নিতে হবে, মুহূর্তে জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে ভিডিও রেকর্ড নেওয়া সম্ভব হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, টকশো পর্যন্ত আমরা করছি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। অফিসের সাপ্তাহিক বৈঠকও হয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। এক মুহূর্তের জন্যও কাজ থমকে যায়নি। প্রযুক্তি আমাদের ছিল কিন্তু সেটি কখন-কোথায়-কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, করোনা পরিস্থিতি সে শিক্ষার সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছে।
করোনায় স্বাস্থ্য সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকট ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এই ক্ষতি অনেককে শেষ করে দিয়েছে। এখন ২০২২ সালে সবার লক্ষ্য হলো আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আবার শক্ত পায়ে দাঁড়ানো। বাংলা ট্রিবিউনের সামনেও যে এই কোভিডকালীন সংকট আসেনি তা বলাটা ঠিক হবে না, কিন্তু ক্রমাগত আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আমরাও আশা বুনেছি— এই বছরটি হবে কোভিড সংকট কাটিয়ে ওঠার বছর।
স্বাস্থ্য কিংবা অর্থনৈতিক সংকট সবকিছুকে জয় করার লক্ষ্য নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বাংলা ট্রিবিউন অষ্টম বছর শেষ করেছে, নবম বছরে স্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রত্যাশার পাশাপাশি পাঠকদের জন্য নিত্য-নতুন আরও আয়োজন নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউনের এই আট বছরে আমাদের যত কর্মী কাজ করে গেছেন, তাদের সবার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাদের ছাড়া এই পথচলা কখনও সম্ভব হতো না। সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ পাঠকদের প্রতি। তাদের ছাড়া বাংলা ট্রিবিউন একদিনও পথ চলতে পারতো না। বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক কাজী আনিস আহমেদ আমাদের সমৃদ্ধ করতে সবসময় পাশে থেকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। সবশেষে আমাদের শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তার ৫০ বছর অতিক্রম করেছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শতবর্ষ উদযাপন করেছে এই জাতি। এই বর্ণাঢ্য ইতিহাস আমাদের অনুপ্রেরণা। বারবার বলে এসেছি, বাংলা ট্রিবিউন ইতিহাসের প্রসঙ্গে কখনও আপস করবে না। এটাই আমাদের মূল শক্তি।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ আমাদের এগিয়ে নেবে আরও বহুদূর। ফিরে আসুক বিশ্বব্যাপী সেই সুন্দর দিন।
জুলফিকার রাসেল
সম্পাদক, বাংলা ট্রিবিউন