X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুস্থ শ্রমিক প্রবাসে গিয়ে অসুস্থ, দায় কার?

উদিসা ইসলাম
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:০০আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৩:১৪

রেমিট্যান্সের বড় অংশই প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান। কিন্তু তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কর্মস্থলে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যবিমাসহ কোনও বিষয়েই তাদের ন্যূনতম সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। এসব বিষয়ে এখনও স্বচ্ছতা আনা সম্ভব হয়নি। এক কাজের কথা বলে আরেক কাজ করানো, চুক্তি অনুযায়ী বেতনভাতা পরিশোধ না করা, অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ শ্রমিকদের অনেকদিনের। প্রবাস থেকে ফিরে আসা শ্রমিকরা বলছেন, কর্মচারীরা স্বাস্থ্য কার্ড চাইলে, নিয়োগকর্তা নানা অজুহাত দেখান। তাদের বলা হয়— কার্ড করতে অনেক টাকা লাগবে। অথচ  তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়— কিছু হলে চিকিৎসার খরচ তিনি (নিয়োগ কর্তা) নিজেই বহন করবেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেতনভাতা ও নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কথা হলেও কেবল স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে যে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হয়েছে, সেটা সামনে আনা এখন সময়ের দাবি।

এনামুল ও শাহিদাদের গল্প

কুমিল্লার বাগরাপুর এলাকার এনামুল হক (ছদ্মনাম)। বয়স ৪৪। ২০০৯ সালে এনামুল ওমানের সালালাহ শহরে অবস্থিত একটি টেইলারিং কোম্পানিতে কাজ করার জন্য পাড়ি জমান। অভিবাসনের খরচ হিসেবে সাড়ে তিন টাকা দেন। তাকে ওমানে খাবার ও বাসস্থানের জন্য অতিরিক্ত ভাতাসহ ৫০ হাজার টাকা বেতনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু  সেখানে পৌঁছানোর পর দেখেন ভিন্ন চিত্র। অতিরিক্ত ভাতা ছাড়াই মাত্র ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। দীর্ঘ ১১ বছর সেখানে দর্জির কাজ করলেও বেতন বাড়েনি। প্রতি দিন ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। তার চাকরির চুক্তিতে কেবল সেলাইয়ের জন্য কাপড়ের টুকরা কাটার দায়িত্ব উল্লেখ থাকলেও নিয়োগ কর্তা তাকে তার সেলাই ব্যবসার জন্য প্রচুর পরিমাণে ভারী কাঁচামাল আনলোড করাতো। এভাবে তিন বছর কাজ করার পর তার বুকে ব্যথা শুরু হয়। নিয়োগ কর্তা তাকে হাসপাতালে নিতে রাজি হননি। এনামুল বলেন, ‘অভিবাসনের আগে বাংলাদেশে তার একটি বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং সে সময়ে কোনও শারীরিক সমস্যা ধরা পড়েনি। এরপর জোর করে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাকে।

দেশে ফিরে এনামুল বাংলাদেশের একটি সরকারি হাসপাতালে দেড় লাখ টাকা খরচ করে অস্ত্রোপচার করিয়েছিলেন। এ  জন্য তাকে তার জমি বিক্রি করতে হয়েছিল। সুস্থ হয়ে আবারও তিনি ওমানে কাজে ফিরে যান। ২০১৯ সালের শেষের দিকে, তার নিয়োগকর্তা তাকে দিন এবং রাত দুই শিফটেই কাজ করান। ১৫ দিন কাজ করার পর তার স্ট্রোক হয়। তিনি দুই দিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। এতে তার ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। নিয়োগ কর্তা একবার দেখতে এসে তাকে মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ২০২০ সালে মহামারি শুরু হওয়ার পর কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে গেলে এনামুলকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

শাহিদা আখতারের বয়স ৩৫। ২০২১ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর গৃহপরিচারিকার কাজ করতে সৌদি আরবে যান তিনি। তাকে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি ২ লাখ টাকা খরচ করে একজন সাব-এজেন্টের মাধ্যমে সৌদিতে যান। এই টাকা তিনি অন্যদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন এবং পরিশোধ করেন। সৌদি আরবে তাকে অকল্পনীয়ভাবে নিষ্ঠুর কাজের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাকে তার নিয়োগ কর্তার ইচ্ছা অনুযায়ী, সারা দিন এবং রাত কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। শাহিদার বিশ্রামের ব্যবস্থা ছিল না। তাকে রাতে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি, বরং তার নিয়োগ কর্তার অসুস্থ মায়ের যত্ন নিতে বাধ্য করা হয়। ঘুমিয়ে পড়লে তাকে মারধর করা হতো। তাকে তার নিয়োগ কর্তার আত্মীয়দের বাড়িতেও কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। নিয়োগ কর্তা তাকে উপযুক্ত খাবার বা পর্যাপ্ত পানি পান করতেও দেননি। এমনকি শাহিদাকে তার নিয়োগ কর্তার ভাইকে দিয়ে যৌন নির্যাতনের হুমকি দেওয়া হয়। আরও নির্যাতনের ভয়ে এবং সেখানকার বিধিনিষেধের কারণে, তিনি চার মাস কাজ করেন। এরপর শাহিদা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপরও,  নিয়োগ কর্তা তাকে চিকিৎসকের কাছে যেতে দেননি। শাহিদার মেয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের নেতার কাছ থেকে সাহায্য নেন, একটি বিমানের টিকিট কিনে তাকে দেশে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এখানে আসার পর ডাক্তাররা  জানান, তার জন্ডিস হয়েছে যা তার লিভারের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশ ছাড়ার আগে শাহিদার একটি বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তখন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন।

শুধু এনামুল ও শাহিদা একা নন, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীন আচরণের জন্য এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে হাজারো শ্রমিককে। কেবল ২০২১ সালে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন শ্রমিক বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরেছেন। স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণে এনামুল ও শাহিদার মতো অনেককেই ফিরে আসতে হয়েছে। এমনকি তারা কোনও পাওনা টাকা নিয়ে আসতে পারেননি। ২০২০ সালজুড়ে কোভিড মহামারিতে ফেরত ৫০ প্রবাসীর ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রত্যাগতদের মাত্র ২৬ ভাগ বকেয়া টাকা নিয়ে ফিরতে পেরেছেন। অবশিষ্টরা গড়ে পৌনে দুই লাখ করে টাকা ফেলে এসেছেন।

কেন চিকিৎসা করতে আগ্রহী নন, প্রশ্নে ফিরে আসা শ্রমিক রেবেকা খাতুন বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে আমাদের মতো শ্রমিকদের চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে কোনও আইনি বাধা নেই। কিন্তু চাকরির নিয়োগ ও ভিসার সমস্যার কারণে সরকারি হাসপাতালের সুবিধা নেওয়া যায় না। বেশিরভাগ সময়ই আমাদের শ্রমিকদের পাসপোর্ট তাদের নিয়োগদাতা কোম্পানির কাছে গচ্ছিত থাকে। সবমিলিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়। সেখানে খরচ অনেক। ফলে সেই খরচ নিয়োগদাতা করতে রাজি হন না।

অভিবাসন-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘আমাদের শ্রমিক তাদের (নিয়োগদাতা দেশ) নির্ধারণ করে দেওয়া জায়গায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে যদি অসুস্থ হয়, সেই দায় কে নেবে। তারা আমাদের দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্ব দিচ্ছে না। সেক্ষেত্রে পুরো দায়তো তাদের। সেই জায়গা থেকে আমরা মনে করি, এখন এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করা জরুরি। কলোম্বো প্রসেস রয়েছে, আবুধাবী আইএলও প্রক্রিয়া রয়েছে, এসবের কোথাও প্রবাসীদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সেটাকে গুরুত্বের জায়গায় নিতে চাই আমরা। নতুন কিছু বলছি তা না, গুরুত্ব বিবেচনায় বিষয়টিকে সামনে আনা জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘এখনকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা গালফ দেশগুলোর নির্ধারিত এজেন্সি করে থাকে, তারা তাদের লিস্ট দিয়ে দেয়। শ্রমিকরা নির্বাচিত হওয়ার পরে সেখানে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। কোন কোন দেশে যাওয়ার পরে দ্বিতীয় বার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো  হয়। সেখানে কিছু পাওয়া গেলে একটা নির্দিষ্ট সময় দিয়ে আবারও তাদের পরীক্ষা করানো হয়। তারপরেও যদি কিছু পাওয়া যায়, তাহলে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’

সি আর আবরার বলেন, ‘আমাদের কথা হলো, তোমাদের নির্ধারণ করে দেওয়া এজেন্সিতে পরীক্ষা করে যাচ্ছে, তাহলে দায়িত্ব তোমাদের নিতে হবে। প্রবাসী যদি অসুস্থ হয়, সেই বিবেচনায় তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা নেই, নিজেরা নিজেদের মতো করে দেশ থেকে নেওয়া ওষুধ খায়। কোভিড এক্সপোজ করে দিয়েছে— এই শ্রমিকদের অবস্থা কতটা নাজুক। আমাদের সরকারের উচিত দায়িত্ব নিয়ে তাদের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়া।’

/এপিএইচ/ 
সম্পর্কিত
নয় বছরে প্রথম ওমরাহ, ইরানি দলের সৌদি আরব যাত্রা
শ্রমবাজার ইস্যুতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বসতে চায় বাংলাদেশ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো ও দেশের সাফল্য তুলে ধরার আহ্বান
সর্বশেষ খবর
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা