X
মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
১০ আষাঢ় ১৪৩২
স্মৃতিকথা

“সেদিন আর কত দূরে”

শেলীনা আফরোজা
৩১ অক্টোবর ২০২২, ২০:২৪আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২২, ১৭:৫১

ঢং ঢং করে কাঁসার ঘণ্টা বেজে উঠলো। সবার নজর কেড়ে নিলো ঘণ্টাবাদক রোজানা খান। মন চলে গেলো কিশোরী জীবনের অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম প্রহরে। নাজিয়া জেবীন বললো আরামে দাঁড়াও, সোজা হও। তারপর ওর নির্দেশে সবাই একসঙ্গে পা মেলালো বাম, ডান, বাম; বাম, ডান, বাম। মনের অজান্তেই ঘটছে সবকিছু, একসাথে সেই ছেলেবেলার স্কুল অ্যাসেম্বলির মতো, শরীরে সে এক অন্য শিহরণ।

দিনটা ছিল ১৫ অক্টোবর, ২০২২। অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন কতিপয় প্রতিভাবান ছাত্রী একসাথে হয়ে কঠোর পরিশ্রম করে গুলশানের জারা কনভেনশন সেন্টারে আয়োজন করে মিলনমেলার। এ প্রসঙ্গে নাজিয়া, রোজানা, বন্দনা, সাফিনা, রোকসানা, কিশোয়ার, লিমা, করোভি, ফেহমিনা, সামিয়া আহমেদ, কনক, নাজিয়া শারমিন, সামিয়া আলী, আফরোজা মিতা ও ঝুমুর নাম উল্লেখ না করলেই নয়। ওরা সফলতার সাথে জড়ো করে ২৬০ জন প্রাক্তন ছাত্রীকে। যারা ১৯৬৯ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এসএসসি পাস করেছিল।

শুরুতেই সবাই অন্তর দিয়ে গাইলো “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”। আমাদের স্কুলে প্রতিদিন অ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি গাইতে হতো কবি গোলাম মোস্তফার লেখা সুরা ফাতিহার অনুবাদ করা প্রার্থনা

 “অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি”
যার সবশেষে আছে,

“যে-পথে তোমার চির-অভিশাপ

যে-পথে ভ্রান্তি, চির-পরিতাপ

হে মহাচালক,মোদের কখনও

করো না সে পথগামী।”

এই শিক্ষাকে ধারণ করেই আজ আমরা পৌঁছে গেছি এতদূর। সবশেষে ছোটবেলার মতো এক দুই, এক দুই তিন ছন্দে হাত তালি দিয়ে শুরু হলো দিনের কাজ।

আমন্ত্রিত শিক্ষাগুরুদের মধ্যে এসেছিলেন ননীবাবু স্যার, সাইদা আপা, কালো আপা ও শাহীন আপা। যাঁদের বয়স ৭০ থেকে ৯০-এর মাঝে। বললেন, কষ্ট হলেও আমাদের দেখার লোভ সামলাতে পারেননি। আমাকে পরিচয় করে দেওয়া হলো বাংলাদেশের প্রথম নারী ম্যাজিস্ট্রেটদের একজন হিসেবে। করতালিতে মুখরিত হলো হলঘর, আমি আপ্লুত।

সবার সেকি কথার ফুলঝুরি। সাংবাদিক সুমনা শারমিন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দেখে সবাই কথা বলছে, বললো কল্পনা করো, আমাদের টুলু আপা হাইহিলের খট খট শব্দ করে এদিকে আসছেন, তাও যদি কেউ কথা বলে তবে বুঝবো সে অগ্রণীতে পড়েনি। আসলেই টুলু আপার পায়ের শব্দে আমাদের হার্টবিট বেড়ে যেতো। স্মৃতিচারণে উঠে এলো বড় আপা, টুলু আপা, হাসান জান স্যার, রহমান স্যার, মতিন স্যার, আনোয়ার স্যার, ফেরদৌসী আপা, খুকুমনি আপা, লাকি আপা, আনোয়ার স্যারসহ সব শিক্ষাগুরুর প্রসঙ্গ। এখন বুঝি তাঁদের কড়া শাসন আর বকুনি ছিল আমাদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার মূলমন্ত্র। হাসান জান স্যার বলতেন, মন খারাপ হলে বিশাল আকাশের দিকে তাকাবে, সম্ভব হলে পাহাড় আর সমুদ্র দেখতে যাবে। দেখবে ওদের বিশালতার কাছে তোমাদের কষ্টগুলো কত তুচ্ছ। আজও মন খারাপ হলে স্যারের কথা মনে পড়বেই। অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনীতে অংশ নেওয়া সাবেক শিক্ষার্থীরা

একদিন, এক স্যার অনুপস্থিত থাকায় ফেরদৌসী আপা এলেন ক্লাসে। বললেন আজ সবার কাছ থেকে হাসির গল্প মানে জোকস শুনবো। নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, হাসতে না পারলে আর জীবন কীসের বলেই হো হো করে হেসে লুটিয়ে পড়লেন। আমাদের আনন্দ দেখে কে। চললো হাসির গল্প বলার প্রতিযোগিতা। হাসি না পেলেও আপা হাসির অভিনয় করেন। একজন বললো, “বিদেশ থেকে স্বামী নতুন বৌয়ের জন্য পারফিউম কিনে এনেছে। পরদিন খেতে বসে বৌকে বললো পারফিউম মেখে আসতে। জবাবে শাশুড়ি বললেন, আমার মেয়েতো ওটা রুটি দিয়ে খেয়ে ফেলেছে।” শুনে আপার চেহারা কঠোর হয়ে গেলো, বললেন গ্রামে থাকে, কম লেখাপড়া করেছে বলে কাউকে কখনও ছোট করে দেখবে না। এ ধরনের গল্প আনন্দ নয় কষ্ট দেয়, যে বলে সেই ছোট হয়ে যায়। আজও ভুলিনি সেই কথা। সেদিন মানুষকে সম্মান করতে শেখার কথা মনে গেঁথে গিয়েছিল স্থায়ীভাবে।

দেখা হয়ে গেলো আশির দশকের পড়শী ছোট্ট জেসমিনের সঙ্গে। সে এখন ডাক্তার। আমার নিকুঞ্জের পড়শী সিমিনও এসেছে। আমরা এক দেয়াল শেয়ার করি অথচ জানা ছিল না একই স্কুলের ছাত্রী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রাচার প্রধান  আমান সাহেবের বৌ রুনা মেহজাবিন আমাকে দেখে আবদার করলো একসঙ্গে ছবি তুলবে। পরিচিত হলাম আমার সিনিয়র কলিগ রাষ্ট্রদূত মন্জুর রহীম স্যারের বোন শামীমা নিরার সাথে। অনেক দিন পর দেখা হলো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া বন্ধু ম্যাজিস্ট্রেট শামীমের ননদ লিমার সঙ্গে। আমার খুব পছন্দের এবং চরম ভালো লাগার মতো মেয়ে ছিল মাহতাবা সিলভী, ১৯৭২ ব্যাচের। দীর্ঘদিন পর তাকে দেখে আমি পুলকিত। মেয়েটা তেমনি সুন্দর আছে। দেখা হলো খালাতো বোন সেলিনা বানু রানুর সঙ্গে। পরিচয় হলো বড়দাদুর পরিচিত ‘সহজ’ ম্যাগাজিনের সম্পাদিকা শায়লা হাফিজের সঙ্গে। অনেকে স্যার বলে সম্বোধন করছেন, ওরা আমাকে চাকরি জীবনে দেখেছেন বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে, মনেও রেখেছেন। একই স্কুলে পড়েছি জেনে আমার মতো ওরাও পুলকিত। শেলীনা আফরোজা

কত কথা যে মনে পড়ছে, সব কি আর লেখা যায়! স্কুল ছুটির পর গেটের বাইরে এসে এদিক সেদিক খুঁজতাম দুজন নবীন নাট্যব্যক্তিত্ব, রামেন্দু মজুমদার আর আহসান আলী সিডনিকে। তাঁরা আমাদের ফেরদৌসী আপা ও খুকুমনি আপার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। আজও ভুলিনি সেসব দিনের কথা।

আমি ১৯৭১ ব্যাচের। বছরজুড়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ হওয়ায় আমাদের পরীক্ষা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। নতুন বাংলাদেশে আমরাই প্রথম এসএসসি ব্যাচ। দীর্ঘ ৫২ বছর পরও যেসব প্রিয় সহপাঠীর নাম মনে করতে পারছি, তা এই সঙ্গে জুড়ে দিলাম।

বাংলাদেশে আছে:

হুমায়রা বানু স্বপ্না, ডালিয়া নওশিন, ডোরিনা, পারভীন আক্তার পারু, রাঙ্গা, সাহারা, যোবায়দা জেবু, দীনা আহসান, ইসমত পারভীন বানু, সারা, টুটুন, শাফকাত, লাকি এবং আমি শেলীনা আফরোজা শেলী।

বিদেশে আছে:

লুৎফুন্নাহার নার্গিস, নাসরীন বীথি, আফরোজা বানু বেলী, মাকসুদা শেখ লিরা ও মনুয়া।

আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে:

মুন্নি, আফরোজা চৌধুরী বুলবুলি আর শিখা।

তোমরা যে যেখানেই থাকো পুরো অনুষ্ঠানে জড়িয়ে ছিলে আমার সত্তায়।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শোনালো তানিয়া মান্নান, আফরোজা খান মিতা, সামিনা চৌধুরী, সিলভিয়া। কবি শায়লা হাফিজ ও নূর সুমি শোনালো স্বরচিত কবিতা। ত্রপা মজুমদারের একদিন স্কুল ভ্রমণের স্মৃতিচারণ মনে দাগ কেটেছিল সবার। স্মৃতিচারণ ছিল অনেকের।

সেদিন অনুষ্ঠানে একুশে পদকপ্রাপ্ত আমার বন্ধু কণ্ঠযোদ্ধা ডালিয়া নওশিন সবার অনুরোধে গান শোনালো, সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুরে,

 “সেদিন আর কতদূরে,

যখন প্রাণের সৌরভে সবার গৌরবে

ভরে রবে এ দেশ

ধন ধান্যে শিক্ষায়

জ্ঞানে-মান্যে আনন্দের গানে গানে সুরে।।

..........

এ দেশ আমার, এ দেশ তোমার বুকের ধন,

করো যতন যেন না কেউ

কাড়ে সেই রতন,

হায় বিভেদ বিচ্ছেদ শেষ দাও করে।।”

গায়ে শিহরণ জাগলো, দেশের জন্য ভালোবাসায় চোখে জল এলো। পুরোনো এই গানটির কথাগুলো আজও কেমন বাস্তব। শিক্ষায়, জ্ঞানে-মান্যে, আনন্দে ভরা দিনের আশায় আমরা এখনও ছুটছি। কি ভীষণ অস্থিরতা আমাদের ঘিরে রেখেছে। নতুন প্রজন্মের মাঝে সঠিক মূল্যবোধ জাগরুকের জন্য আজও আমাদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি তীব্র আকর্ষণ দূরে ঠেলে দিচ্ছে নিজের ঐতিহ্যকে। তাই স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার করেও বলতে হচ্ছে “সেদিন আর কত দূরে।”

অনুষ্ঠানের একদম শেষে “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে” রবি ঠাকুরের এই কালজয়ী গানের সঙ্গে ওয়ার্দা রিহাবের দলগত নাচের একপর্যায়ে ওয়ার্দার স্টেজ থেকে নেমে শিক্ষাগুরুকে পা ছুঁয়ে সালাম করার দৃশ্য সবার মন স্পর্শ করে গেছে।

আমাদের সময় স্কুলের দেয়ালে অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, শ্রদ্ধেয় হোসনে আরা ইসলাম, ড. নুরুন নাহার ফয়জুন্নেসা, মিসেস আনওয়ারা মনসুর ও ড. রোকেয়া মান্নানের ছবি প্রদর্শিত ছিল। স্কুলের ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধির নিদর্শনস্বরূপ স্কুলে তাঁদের ছবি পুনঃস্থাপনের দাবি যদি তোলা হয়, তা কি খুব বেশি চাওয়া হবে? তাঁদের স্বপ্ন যেন পূরণ করতে পারে অগ্রণী বিদ্যালয়ে সৃষ্ট সব প্রজন্ম। অগ্রণীর ছাত্রীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশের জন্য বিশেষ অবদান রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে- এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

জয়বাংলা, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক: প্রাক্তন ছাত্রী, অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়; প্রাক্তন সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

/এসএএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ড্র করে নকআউটে পিএসজিকে পেলো মায়ামি 
ড্র করে নকআউটে পিএসজিকে পেলো মায়ামি 
ফ্ল্যাট বিক্রিতে ধস, নির্মাণ খাতে ছাঁটাইয়ের শঙ্কা
ফ্ল্যাট বিক্রিতে ধস, নির্মাণ খাতে ছাঁটাইয়ের শঙ্কা
ইসরায়েল ‘অবৈধ আগ্রাসন’ বন্ধ করলে হামলা থামাবে ইরান
ইসরায়েল ‘অবৈধ আগ্রাসন’ বন্ধ করলে হামলা থামাবে ইরান
দেশে প্রথমবারের মতো গুগল পে চালু হচ্ছে আজ, যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে
দেশে প্রথমবারের মতো গুগল পে চালু হচ্ছে আজ, যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে
সর্বাধিক পঠিত
ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায় মন্দা, নেপথ্যের কারণ কী
ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায় মন্দা, নেপথ্যের কারণ কী
প্রধান উপদেষ্টা ও দুদককে উকিল নোটিশ পাঠালেন টিউলিপ
প্রধান উপদেষ্টা ও দুদককে উকিল নোটিশ পাঠালেন টিউলিপ
৫ আগস্টের পর ক্ষমতার বিরোধে দুই বন্ধু হয়ে গেলেন শত্রু, ঘটে গেলো জোড়া খুন
৫ আগস্টের পর ক্ষমতার বিরোধে দুই বন্ধু হয়ে গেলেন শত্রু, ঘটে গেলো জোড়া খুন
কাতার ও ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
কাতার ও ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
কাতারের উদ্দেশে ছাড়া ফ্লাইট নামলো ওমানে, আবার ফিরছে ঢাকায়
দোহাগামী বিমানের সব ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণাকাতারের উদ্দেশে ছাড়া ফ্লাইট নামলো ওমানে, আবার ফিরছে ঢাকায়