X
রবিবার, ১৬ জুন ২০২৪
২ আষাঢ় ১৪৩১

দিন শেষে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের ‘নিজেদের স্কুল’

উদিসা ইসলাম, কক্সবাজার থেকে ফিরে
০১ নভেম্বর ২০২২, ১০:২৯আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২২, ১১:০৯

২০১৭ সালে মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাত লাখ রোহিঙ্গা। তাদের শিশু-কিশোরদের শিক্ষার জন্য নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হলেও তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে ক্যাম্পে গড়ে তুলেছে প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবস্থা। ক্যাম্পে ক্যাম্পে দাতাগোষ্ঠীর ‘লার্নিং সেন্টার’ থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত পড়ালেখার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষিত রোহিঙ্গারা এই ‘প্রাইভেট সেন্টার’ খুলে বসেছেন। প্রশাসন বলছে, বিষয়টি তারা অবহিত আছেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর স্থানীয় অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, বাংলাসহ নিয়মিত বিষয়গুলো লেখাপড়া করে রোহিঙ্গারা বাঙালিদের সঙ্গে মিশে গেলে বিপদ বাড়বে।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালের আগে থেকে অন্তত লাখচারেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনাচৌকিতে জঙ্গি হামলার অজুহাত দেখিয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এরপর থেকে পরের কয়েক মাসে বাংলাদেশে এসেছে আরও সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে কক্সবাজারে।

লার্নিং সেন্টারে এক থেকে দুই ঘণ্টার জন্য আসে রোহিঙ্গা শিশুরা। বালুখালী ক্যাম্প-৯ থেকে ছবিটি তুলেছেন প্রতিবেদক

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পড়ার যত আয়োজন

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আগমনের পর শিশুদের কিছুটা সাক্ষরতা এবং সংখ্যা (গণিত) শেখার জন্য  জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে অনানুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয়েছিল। এটাকে আনুষ্ঠানিক এবং  কোনোভাবেই মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এর চারটি স্তর শুধুমাত্র ৪ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছোট বাচ্চাদের জন্য। ২০২১ সালের নভেম্বরে ইউনিসেফ এবং অংশীদারদের উদ্যোগে চালু করা মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে ১০ হাজার শিশু-কিশোরের জন্য পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। শুরু থেকেই এত সংখ্যক শিশুকে কীভাবে পড়ালেখার মধ্যে আনা যাবে, সে নিয়ে ছিল অনেক উদ্বেগ।

উল্লেখ্য, ইউনিসেফের হিসাব বলছে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে ৪ লাখ স্কুল যাওয়ার উপযোগী শিশু রয়েছে। এই শিশুদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ শিক্ষাকেন্দ্রে গেছে। একাধিক ক্যাম্পে ৩ হাজার ৪০০টি লার্নিং সেন্টার রয়েছে, যার মধ্যে ২ হাজার ৮০০টি ইউনিসেফের সমর্থিত।

লার্নিং সেন্টারে এক থেকে দুই ঘণ্টার জন্য আসে রোহিঙ্গা শিশুরা। বালুখালী ক্যাম্প-৯ থেকে ছবিটি তুলেছেন প্রতিবেদক

কেন ‘গোপন’ ও ‘প্রাইভেট’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরকার ও দাতাগোষ্ঠীর অগোচরে কোনও ধরনের শিক্ষা কার্যকম পরিচালনা বৈধ নয়। অথচ, সেখানে এখন ক্যাম্পে ক্যাম্পে রয়েছে প্রাইভেট পড়ার সুব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, কোন কোন বিষয়ে পড়তে চান এবং কোন বয়সী, সে অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে নির্ধারণ হয় শিক্ষার্থীর বেতন বা ফি। ক্যাম্পের মধ্যে যে বেসরকারি কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হয়— সে সবের কর্মীরা সাধারণত সকাল ৮টার দিকে ক্যাম্পগুলোতে ঢোকেন এবং বিকাল ৪টায় ক্যাম্প এলাকা ত্যাগ করেন। বালুখালি ক্যাম্প-৯ এ প্রাইভেট পড়ান এমন একজন শিক্ষক বলেন, ‘কর্মীরা ক্যাম্প এলাকা ছাড়ার পর আমরা প্রাইভেট পড়াই। সকালে যারা লার্নিং সেন্টারে যায়, তারা বিস্কুট পায় ঠিকই, কিন্তু পড়ালেখা সেখানে খুব সীমিত। আমাদের সন্তানেরা শিক্ষিত হওয়ার অধিকার রাখে। ফলে ভবিষ্যতে তারা যেনো কিছু করে খেতে পারে, সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এই প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়টি এসেছে।’

প্রাইভেট পড়াতে ৩০০ টাকা জোগাড় করেন কীভাবে, আপনাদের তো টাকা দেওয়া হয় না, প্রশ্নের জবাবে এক অভিভাবক বলেন, ‘ছেলের বাবা ক্যাম্পের ভেতরে দিনজুরের কাজ করে। এনজিও’র ছোটখাটো কাজে আমাদের লাগানো হয়। ওরা কিছু কাজের বিনিময়ে টাকাও দেয়। এই করেই জোগাড় হয়। সন্তান মুর্খ বসে থেকে কখনও যদি নিজ দেশে ফেরে, তখন কী করে জীবন যাপন করবে? তাই কষ্ট করে হলেও প্রাইভেটে পড়াই।’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টা আমাদের নজরে আছে এবং আমরা এগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করছি। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধও করা হয়েছে, অভিযান চালিয়ে। আবার জাতিসংঘের  নির্দেশনা আছে ‘হোম বেজড লার্নিং’ চালু রাখার। সেটা প্রাইভেট হচ্ছে নাকি কোন উপায়ে হচ্ছে, সেই পার্থক্য টানাটা কঠিন। ক্যাম্পের ভেতরে যে লার্নিং সেন্টারগুলো আছে, সেগুলোতে শিশুরা যাচ্ছে। কিন্তু তার বাইরেও তাদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তারা এই প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়টি ঘটাচ্ছে। এতে করে যাদের হাতে কিছু টাকা আছে, তারা তাদের ছেলেমেয়েদের আরেকটু বেশি শিক্ষিত করার কথা ভাবছে। আর যারা পড়াচ্ছে, তারা কিছু আয়-রোজগার করছে। ক্যাম্পে যে লার্নিং সেন্টারগুলো আছে— সেগুলো যদি পূর্ণাঙ্গ হতো, তাহলে আর এই সমস্যা হতো না।’ খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের বিষয়ে সেখানো পড়ানো হয় বলে এই প্রাইভেটের বিষয়টি বেড়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।

এমন সাধারণ ঘরগুলোই স্কুল ঘরের মতো সাজানো হয় শিক্ষার্থীদের জন্য। ছবি: প্রতিবেদক

এদিকে এই প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়টি খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে ‘কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলন’র সাধারণ সম্পাদক আয়েছুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছিলাম— এ ধরনের কিছু ঘটতে দেওয়া যাবে না। ক্যাম্পের ভেতরে মসজিদকেন্দ্রিক কিছু মাদ্রাসা আছে। কিন্তু এই ধরনের প্রাইভেটে অন্যান্য বিষয়াদির সঙ্গে বাংলাও পড়ানো হয়। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হচ্ছে। তাদের গড়ন, পোশাক, চলাফেরা, খাদ্যাভ্যাস বাঙালি মুসলমানদের মতোই। ভাষাটাও যদি শিখে ফেলে, তাহলে তাদের আলাদা করার আর কোনও সুযোগ থাকবে না। এই বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের কড়া অবস্থান নেওয়া জরুরি।’

/এপিএইচ/ইউএস/
সম্পর্কিত
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাইফেল ও গুলিসহ আরসা কমান্ডার গ্রেফতার
সারা দেশে কত রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছেন, জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার
সর্বশেষ খবর
এ বছর বরিশাল রুটে লঞ্চে চাপ বেড়েছে
এ বছর বরিশাল রুটে লঞ্চে চাপ বেড়েছে
বিশ্ব বাবা দিবস আজ
বিশ্ব বাবা দিবস আজ
নামিবিয়াকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের অপেক্ষায় ইংল্যান্ড
নামিবিয়াকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের অপেক্ষায় ইংল্যান্ড
টিভিতে আজকের খেলা (১৬ জুন, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৬ জুন, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
রেমিট্যান্সের পালে স্বস্তির হাওয়া, রিজার্ভেও উন্নতি
রেমিট্যান্সের পালে স্বস্তির হাওয়া, রিজার্ভেও উন্নতি
আমরা আক্রান্ত হলে ছেড়ে দেবো না: সেন্টমার্টিন নিয়ে ওবায়দুল কাদের
আমরা আক্রান্ত হলে ছেড়ে দেবো না: সেন্টমার্টিন নিয়ে ওবায়দুল কাদের
কেমন থাকবে ঈদের দিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে ঈদের দিনের আবহাওয়া?
বেনাপোলে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়, পেট্রাপোল ইমিগ্রেশনে ভোগান্তি
বেনাপোলে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়, পেট্রাপোল ইমিগ্রেশনে ভোগান্তি
‘মাস্তান’ গরুটির জন্য কাঁদছে দর্শক
‘মাস্তান’ গরুটির জন্য কাঁদছে দর্শক