X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাসে ১০ কেজি ওজন কমানোর ‘ওষুধ’: ভেতরে কেঁচো নাকি সাপ?

উদিসা ইসলাম
০৮ নভেম্বর ২০২২, ১৮:০১আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২২, ১৩:৪৮

ফেসবুকে হাজার হাজার পেজ খুলে ‘এক মাসে ১০ কেজি পর্যন্ত ওজন কমানোর’ বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা ও অবৈধ পথে টাকা আয়ের অভিযোগ মিলেছে। এসব ওষুধ কিনে প্রতারিত হওয়ার কথা অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, ‘ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ক্যাপস্যুল, গ্রিন কফি, গ্রিন টি, নানারকম ওয়েট কমানো জুস খেলে কোনও ব্যায়াম বা ডায়েট ছাড়াই কমবে ওজন’—এমন চটকদার অফারে সয়লাব হোমপেজ। যদিও এদের কিছু কিছু পণ্যের অনুমোদন আছে। তবে ঠিক এই ধরনের অফার দিয়ে বিক্রয় হবে—সে তথ্য লুকিয়ে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।

একাধিক পণ্যের গায়ে ডিএআর নম্বর দেওয়া থাকলেও ওষুধ প্রশাসনের ওয়েবসাইটে সেই নম্বরের অস্তিত্ব নেই। ওষুধ, খাদ্যপণ্য, পানীয় অনুমোদন দেয় যেসব প্রতিষ্ঠান তারা বলছে, এসব পণ্য অনুমোদন নেওয়ার সময় ঠিক কী কাজে ব্যবহার হবে তার জায়গায় যদি এরকম এক সপ্তাহে ওজন কমানোর কথা উল্লেখ থাকে তবে তার অনুমোদন মেলার কথা না। ফলে একটি প্রতারক গোষ্ঠী এক কথা বলে অনুমোদন নিয়ে আরেক কথা বলে এ ধরনের কাজ করছে—এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

চিকিৎসকরা বলছেন, একমাসে এই পরিমাণ ওজন কমাতে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে তার সাইডইফেক্ট থাকবে না, এটা হতেই পারে না। চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়া এ ধরনের ওষুধের অনুমোদন থাকলেও বিক্রি করা অপরাধ।

অফার দেখেই  প্রতারণা চেনা যায়

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে বিস্ময়কর  তথ্য। ৫৫টি পেজ পর্যবেক্ষণ করে এবং ১১টি পেজের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব পণ্যের চাহিদা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। একইসঙ্গে তারা স্কিন কেয়ার ক্যাপসুল দেয়, সেটার কারণে বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে। পেজগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষা কমবেশি একই রকম।

ওজন কমানোর কথা বলে চটকদার বিজ্ঞাপনে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের ওষুধ ও পানীয়

সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন দেখা যায় সেই স্লিমিং সফট ড্রিংকের। এ বিষয়ে পেজগুলোর দাবি, ‘এটি ১ মাসে সর্বোচ্চ ৮-১০ কেজি ওজন কমাবে। পুরো শরীর এবং পেটের চর্বি কমাবে। ডায়েট ও ব্যায়াম ছাড়া ওজন কমাবে’।

কী পদ্ধতি কাজ করবে জানতে চাইলে পেজগুলো থেকে বলা হয়, ‘খাবারকে দ্রুত হজম করবে এবং ফ্যাট বার্ন করবে। পেটের বিষাক্ত গ্যাস দূর করবে। বডির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অতিরিক্ত চর্বি ও টক্সিন বার্ন করে টয়লেটের মাধ্যমে বের করে দিবে’।

কোথায় থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে—প্রশ্নে কোনও কোনও পেজ বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) থেকে পরীক্ষা করার একটি সার্টিফিকেট দিয়ে জানায় এতে সাইডইফেক্ট নেই।

ওজন কমানোর কথা বলে চটকদার বিজ্ঞাপনে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের ওষুধ ও পানীয়

যোগাযোগের সময় তারা তাদের পণ্যের সাইডইফেক্ট না থাকার সনদ, তাদের পণ্য খেয়ে ১৫ কেজি পর্যন্ত ওজন কমেছে—এমন অনেকের ফেসবুক কমেন্ট এবং তাদের পণ্য ব্যবহার করে খুব খুশি হয়েছে এমন অনেকের ইনবক্স কথোপকথনের স্ক্রিনশট দিয়ে আশ্বস্ত করে। কিন্তু পণ্যের মান ও এর বৈধতা নিয়ে যত বেশি অনুসন্ধানে করা যায় ততই যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার অবস্থা তৈরি হয়। এমনকি একই প্রোডাক্ট  বিক্রির জন্য একেকটি গোষ্ঠী একাধিক পেজ খুলেছে। পণ্য বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেওয়া ফোন নম্বর একই হওয়ায় সেটি সহজেই নজরে আসে।

কেউ বলছে, ‘মেদ ভুঁড়ি ওজন স্থায়ীভাবে না কমলে শতভাগ মানিব্যাক গ্যারান্টি’। কেউ বলছে, ‘তার পণ্য বাংলাদেশ সাইন্সল্যাব কর্তৃক অনুমোদিত’। কেউ দিচ্ছে ৩০ শতাংশ ছাড়ে সারা বাংলাদেশে হোম ডেলিভারি। মানুষকে দৌড়াতে হবে না, খাবার সীমিত করতে হবে না, ব্যায়ামও করতে হবে না, কেবল নিয়ম করে ওষুধ খেতে হবে আর চর্বিযুক্ত খাবার অ্যাভয়েড করতে হবে। একবার ওজন কমলে তারপরে আর বাড়বেও না। এমনকি ওজন কমানোর কারণে যেন স্কিনে প্রভাব না পড়ে সেজন্যও তারা ক্যাপসুলের অফারও দিয়ে দিচ্ছে।

ওজন কমানোর কথা বলে যেসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর কার্যকারিতার পক্ষে সাফাই দিয়ে কমেন্টও করছেন অনেকে

এই গোষ্ঠীর সবকিছুই প্রতারণা বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। যথাসময়ে বন্ধ না করা গেলে এর পরিণতি খারাপ হবে বলেও আশঙ্কা তাদের। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তাওহীদা রহমান ইরিন বলেন, কীভাবে ওজন কমাতে হবে তা সাধারণত পুষ্টিবিদরা একটা নির্দেশনা দিয়ে দেন। কোনও প্রেসক্রিপশন ছাড়া, পুষ্টিবিদের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবে হঠাৎ ওজন কমলে তার নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে। কিডনি, লিভারসহ নানা অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর স্কিনের কোনও ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া বা ব্যবহার বিপজ্জনক। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। 

বিএসটিআইআর আবার কোন প্রতিষ্ঠান?

একটি পেজ থেকে দেওয়া বিজ্ঞাপনে বলা হয় একটি জুসের কথা। যা খেলে সর্বনিম্ন ৮ থেকে ১০ কেজি আর সর্বোচ্চ ২০ কেজি ওজন কমানো যাবে। এটি ‘বিএসটিআইআর’ অনুমোদিত এবং পরীক্ষিত।

অথচ এই নামে অনুমোদনদানকারী কোনও প্রতিষ্ঠান নেই। ইনবক্সে অনুমোদনের প্রতিষ্ঠানের নাম জিজ্ঞেস করলে আবারও এই একই উত্তর মেলে।

বিএসটিআই-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, এই পণ্য অনুমোদন দেওয়ার কোনও সুযোগ তাদের নেই। প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক (সিএম) রিয়াজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যদি ওষুধ হয়ে থাকে তাহলে ওষুধ প্রশাসন ও যদি লিকুইড হয়ে থাকে তাহলে হয়তো নিরাপদ খাদ্য থেকে দিতে পারে। আমাদের এখান থেকে এসবের কোনও অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

ওজন কমানোর কথা বলে চটকদার বিজ্ঞাপনে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের ওষুধ ও পানীয়

নিমেষে বদলে যায় পেজের নাম

স্লিম হওয়ার আয়ুর্বেদী ইউনানি ক্যাপস্যুল কেনার পর দেখা যায় এর ইউনানি ফাইলে যে রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি রয়েছে সেটির অস্তিত্ব নেই। তবে আয়ুর্বেদী ফাইলে যে নম্বর রয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ওয়েবসাইটে সেই নম্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু ১০ দিনে চার কেজি ওজন কমিয়ে দেবে এ ধরনের ক্ষমতার ওষুধ এই দাবি করে অনুমোদন যে নেওয়া হয়নি।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক আইয়ুব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার মনে হয় না এরকম কোনও দাবি  করে অনুমোদন নেওয়ার সুযোগ আছে। আপনি যদি জিনিসগুলো নিয়ে আমাদের ওয়েবসাইটে অভিযোগ করেন তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। আর এ ধরনের কোনও পণ্যের অনুমোদন বিএসটিআই বা অন্য কোনও প্রশাসন থেকে নেওয়ার সুযোগ নেই। এটা অবশ্যই ওষুধ প্রশাসন হয়েই যেতে হবে।

এরপর সেই পেজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা  সম্ভব হয়নি। পেজটিকে  ভিন্ন নামে আবার সামনে আসতে দেখা গেছে।

যা বলছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ

যারা অনুমোদন নিয়ে এ ধরনের পণ্য বিক্রি করছে তারা প্রতারণা করছেন উল্লেখ করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) কাউকে অনুমোদন দিতে পারে না। যারা অনুমোদনের কথা বলছে তারা  প্রতারণা করছে।

তিনি আরও বলেন, বিজ্ঞাপনের নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। সেখানে স্পষ্ট করে যে বিষয় উল্লেখ থাকবে তাহলো, এ ধরনের বিজ্ঞাপন বা পরামর্শ চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ ছাড়া দেওয়া যাবে না।

ওজন কমানোর দাবি করে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের ট্যাবলেট

কেউ অভিযোগ করে না কেন?

সায়েমা (ছদ্মনাম) এই ওষুধ ৩০ দিনের জন্য কিনেন। ৪ দিন পর আর সেটি খাননি। এই চারদিনে তিনি ভয়াবহভাবে  পেট খারাপের শিকার হন এবং পানিশূন্যতায় হাসপাতালে ভর্তি হন। সেরে উঠতে ১১ দিন সময় লেগেছে। নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা তিনি বলেননি কাউকে। কিন্তু যেখান থেকে জিনিসটি নিয়েছিলেন তাদের পেজ আর খুঁজে পাননি।

তিনি বলেন, আমার মনে হয় চক্রটি সাংঘাতিক এবং ইন্টারকানেকটেড। চিকিৎসক ছাড়া এ ধরনের ওষুধ গ্রহণ করা একেবারেই উচিত না।

এখন পর্যন্ত এই ওষুধ বা চা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ অভিযোগ করেননি উল্লেখ করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের মাসুম আরেফিন বলেন, যদি কেউ অভিযোগ করে তবে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

/এমআর/
সম্পর্কিত
সাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের নামে ফেক আইডি, মামলা করতে এসে ধরা
অন্যের হয়ে সরকারি চাকরির মৌখিক পরীক্ষা দিতে এসে ধরা পড়লেন ৩ জন
কিরগিজস্তানে কাজ দেওয়ার নামে কোটি টাকার প্রতারণা!
সর্বশেষ খবর
সবসময় সবাইকে সুযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না: রাজ্জাক
সবসময় সবাইকে সুযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না: রাজ্জাক
কলিম শরাফীর জন্মশতবার্ষিকীতে শর্মিলার অ্যালবাম
কলিম শরাফীর জন্মশতবার্ষিকীতে শর্মিলার অ্যালবাম
উপজেলা নির্বাচনে ভোট দিলেন সাকিব
উপজেলা নির্বাচনে ভোট দিলেন সাকিব
কুড়িগ্রামের তিন উপজেলায় ৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছে
কুড়িগ্রামের তিন উপজেলায় ৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছে
সর্বাধিক পঠিত
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ