দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নতুন জোয়ার এনে এরশাদের পতন তরান্বিত করেছিল যার অপার ত্যাগ; সেই নূর হোসেনের স্মরণে নির্মিত চত্বরটিই অবহেলায় পড়ে রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিত্যনতুন ব্যানারে ঢাকা থাকে নূর হোসেন চত্বর। বুধবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে শহীদ নূর হোসেন চত্বর সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় এই চিত্র।
১৯৮৭ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের স্মরণে প্রতি বছর ১০ নভেম্বর দিনটি পালন করা হয়। নূর হোসেন পেশায় একজন অটোরিকশা চালক ছিলেন। আন্দোলনের সময় তিনি বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এবং পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে মিছিলে যোগ দেন। মিছিলের একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহীদ নূর হোসেন স্মৃতিস্তম্ভ ঢাকা পড়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানার ফেস্টুনে। আছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনচিত্রও। নূর হোসেনের স্মৃতি এখানে এতটাই বিস্মৃত যে, অধিকাংশরাই এটিকে জিরো পয়েন্ট নামেই চেনেন।
প্রতি বছর ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেনকে স্মরণ করলেও তার স্মৃতিস্তম্ভটি রক্ষণাবেক্ষণের যেন কেউ নেই। যেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়, তার ভেতরের অবস্থাও বড়ই নাজুক। চত্বরের ভেতরে মধ্যখানে একটি ছোট গাছ আছে, সেটার পাশে একটা ফুল গাছও হয়েছে। তাতে দুটি ফুলও ফুটে আছে। তবে ভেতরে ইঁদুরের গর্তের জন্য পা ফেলার ফুরসত নেই।
গুলিস্তান নূর হোসেন স্কয়ারের পাশের ফুটপাতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করেন বরকত মিয়া। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নূর হোসেন স্কয়ার রাস্তার মাঝখানে হওয়ায় কেউ এসে এখানে দাঁড়িয়ে তাকে স্মরণ করতে পারেন না। এছাড়া তার যে ত্যাগ, তাতে প্রতিবছরের একটি দিন ছাড়া তার কথা কেউ মনেও করে না।’
এই ব্যবসায়ীর দাবি, ‘নূর হোসেন স্কয়ারটি এখান থেকে সরিয়ে ফেলা উচিৎ। এটিকে সুবিধাজনক কোথাও রক্ষণাবেক্ষণ করার পাশাপাশি তার সম্পর্কে লেখা পোস্টার, বিভিন্ন ডকুমেন্টারি করে নতুন প্রজন্মকে জানানো উচিত।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘নূর হোসেন হচ্ছেন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক। তার স্মরণে তৈরি স্মৃতিচত্বরকে আরও মর্যাদার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করা দরকার।’
৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেনের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। নূর হোসেনের এই আত্মত্যাগ তৎকালীন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। যার এক পর্যায়ে স্বৈরাচারী শাসক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
পল্টন মোড় থেকে গুলিস্তান মাজারের দিকে যেতে এবং সচিবালয় থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও স্টোডিয়ামের দিকে আসতে ডাক বিভাগের মুখেই প্রধান সড়কের ওপরে সেদিন মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান এই প্রতিবাদী যুবক শহীদ নূর হোসেন।
সেদিন তার ছবি তুলেছিলেন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী দিনু আলম। বুধবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলছিলেন, ‘নূর হোসেনের তিনটি পোর্ট্রেট ছবি তুলেছিলাম—জিরো পয়েন্ট ও জিপিওর মাঝামাঝি স্থানে। তাকে দেখে বললাম, ভাই দাঁড়ান, আপনার ছবি তুলি। নূর হোসেনকে দেখেই মনে হচ্ছিল জ্বলন্ত পোস্টার হেঁটে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু মনে পড়ে— তিনি এই ছবির মতোই হাত উঁচিয়ে বললেন- দাঁড়াইয়া গেলাম ভাই, (ছবি) লইয়া লন।’