নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনায় খেলার মাঠকে বিনোদন সুবিধার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অবকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করা হলেও সকলের জন্য প্রবেশগম্য এলাকাভিত্তিক খেলার মাঠ তৈরির রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ খুবই সীমিত।
সোমবার (৫ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর প্লানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
তারা বলেন, খেলার মাঠে অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণ কিংবা বিভিন্ন ক্লাব কিংবা স্বার্থান্বেষী মহলের দখলের কারণে শিশু-কিশোর ও এলাকাবাসী খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই বাস্তবতায় খেলাধুলার সুযোগকে সুস্থভাবে বেড়ে উঠার মৌলিক অধিকার বিবেচনা করে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, কার্যকর বাস্তবায়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া আশু প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় শিক্ষা নীতি অনুযায়ী প্রতিটি বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা একেবারেই মানা হচ্ছে না। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ থাকলেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ প্রায়শই অনুপস্থিত।
আইপিডি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি তিন থেকে ৫ হাজার মানুষের জন্য একটি করে শিশুদের (৩-৬ বছর) খেলার মাঠ (প্লে লট), কিশোরদের জন্য (৭-১২ বছর) প্লেগ্রাউন্ড ও বড়দের জন্য (১৩ ঊর্ধ্ব বয়সী) প্লেফিল্ডের সুবিধা থাকতে হয়। আমাদের নগর এলাকার জনসংখ্যা ও ধরন অনুযায়ী নগর এলাকায় খেলার মাঠের তীব্র সংকট আছে উল্লেখ করে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীতে খেলার মাঠের ঘাটতি ৭৯৫টি, চট্টগ্রামে ৫৪১টি, রাজশাহীতে ৩৭টি, খুলনাতে ৬৬টি, সিলেটে ৩২টি ও বরিশালে ৩৪টি। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নগর ও গ্রামীণ এলাকায় সকলের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক খেলার মাঠ তৈরি না করা গেলে আমাদের স্বাস্থ্যগত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত প্রজন্মকে বহন করে যেতে হবে, জাতিগতভাবে যার মূল্য হবে ভয়াবহ।'
ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (কোয়াব) সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল বলেন, শুধু ঢাকা শহরের খেলার মাঠই নয়, ধ্বংস হয়েছে নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বেশিরভাগ শহরেরই খেলার মাঠ। ফলে আগে সারা দেশের পাড়া-মহল্লা-এলাকার মাঠ থেকে যেভাবে খেলোয়াড় তৈরি হতো, সেটাও এখন আর সেভাবে হচ্ছে না। বিভিন্ন ক্লাব ও মহল জনগণের খেলার মাঠ দখল করে আছে, খেলার মাঠের উন্নয়ন করতে গিয়ে সবুজ পরিকল্পনাকে বাদ দিয়ে ইট-কংক্রিট দিয়ে মাঠকে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই ক্রিকেটার।
ময়মনসিংহ ক্রিকেট একাডেমির সভাপতি আরিফ চৌধুরী রাসেল বলেন, খেলার মাঠ তৈরির জন্য আমাদের আইন তৈরি করা দরকার। সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে খেলার মাঠ ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া হাউজিং কোম্পানিগুলো আবাসিক এলাকা তৈরি করতে গিয়ে খেলার মাঠ তৈরির বিষয়টি একদমই ভুলে যায়।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ বলেন, ছোটবেলায় মতিঝিলের যেই জায়গায় বন্ধুদের নিয়ে খেলতাম, তা এখন বহুতল ভবন ‘সিটি সেন্টার’। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়মুক্ত হতে এখন সময় এসেছে খেলার মাঠ নিয়ে বড় রকমের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার।
বাংলাদেশে জাতীয় নারী ফুটবল দলের ফুটবলার আফিদা খন্দকার বলেন, আমাদের ছোটবেলায় যেসব খেলার মাঠে খেলাধুলা করা যেত, সেগুলোর অধিকাংশই এখন আর নেই। খেলাধুলার সুযোগের অভাবে ছেলেমেয়েরা মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা বলেন, পুরান ঢাকাতে আমরা যেসব এলাকায় খেলাধুলা করে বড় হয়েছি, তার অধিকাংশতেই এখন খেলার সুযোগ নেই। খেলার মাঠ নিয়ে আন্দোলন করেও সেগুলোকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। পাড়া-মহল্লায় খেলাধুলা করবার সুযোগ না পেলে আমাদের শিশুরা কীভাবে সুস্থ থাকবে—এই প্রশ্ন রাখেন তিনি।
আইপিডির উপদেষ্টা পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ ও পরিচালক মোহাম্মদ আরিফল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফরহাদুর রেজাসহ অন্যান্যরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।