প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন এবং লবণাক্ততার সমস্যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী বা তাদের স্বজনদের খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও পানি স্বল্পমূল্যে কিনে খাওয়ার বন্দোবস্ত থাকলেও এমন অনেকে আছেন যাদের সেই সামর্থটুকুও নেই। রোগ সারাতে এসে পানিবাহিত নতুন রোগ নিয়ে বাসায় ফিরতে হচ্ছে অনেক রোগীকে। এসব হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন, ‘সরকারি হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে পানির জন্য টাকা নিতে খারাপ লাগে। কিন্তু উপায় তো নেই। পানির জন্য অধিদফতর থেকে জন্য আলাদা কোনও বরাদ্দ নেই।’
আজ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। ‘আসুন, বিষণ্নতা নিয়ে কথা বলি’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো দিবস পালনে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এবারে শীতের পর থেকেই খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও এর আশপাশের অঞ্চলের গভীর নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। সুপেয় পানির অন্য উৎসগুলো আরও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। লবণ পানি পরিশোধনে যে ফিল্টারগুলো বসানো হয়েছিল সেগুলোও অকেজো হয়ে পড়ায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ। এই পরিস্থিতিতে উপকূলীয় জেলা উপজেলার হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহ করা জরুরি। হাসপাতালে খাবার পানির পাশাপাশি অস্ত্রোপচার, হাত ধোয়া, রোগীর ব্যবহৃত থালা বাসন, বিছানার চাদর ও পোশাক পরিষ্কারের ক্ষেত্রেও নিরাপদ পানি প্রয়োজন হয়। এসব কাজে ব্যবহৃত পানিতে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু থাকলে রোগীর সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। অথচ উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক হাসপাতালে হাসপাতাল পরিচালনার জন্য ন্যূনতম যেটুকু পানি দরকার তাও নেই।
খুলনার ১০ ইউনিয়নের মানুষের জন্য পাইকগাছা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। প্রতিদিন বাইরে থেকে দেড় শতাধিক রোগী কম খরচে চিকিৎসা সেবা পেতে এখানে যান। খাবার পানির ব্যবস্থা না থাকায় রোগীদের বাইরে থেকেও পানীয় জল কিনতে হয়, যা তাদের চিকিৎসার খরচ বাড়িয়ে দেয়। ওয়াটার এইডের সহায়তায় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে মুজিব কয়েন দিয়ে পানি কেনার সুযোগ আছে। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মতো মোংলা, শরণখোলা, দাকোপসহ উপকূলীয় এলাকার প্রায় ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর অধীনে থাকা সাব সেন্টারে রয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। স্থানীয় পৌরসভা বা ওয়াটার এইডের মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা করে রোগীদের পানির চাহিদা পূরণ করছে এসব হাসপাতাল। সেজন্য রোগীর কাছ থেকে পানির খরচ নিতে হয় তাদের। কোনও কোনও হাসপাতালে অবশ্য রোগীরা বাইরে থেকেই পানি কিনতে হয়।
পাইকগাছার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নীতিশ চন্দ্র গোলদার বলেন, ‘এখানে সুপেয় পানির অনেক সংকট। ডিপ টিউবওয়েলের পানি ওঠে না। শ্যালো টিউবওয়েলের পানিতে প্রচুর আয়রন। পুকুরের পানি পাম্পের মাধ্যমে হাসপাতালে ব্যবহার করা হয়। আর ওয়াটার ভেন্ডিং মেশিন থেকে দেয় ২ টাকার মুজিব কয়েন ও ৫ টাকার মুজিব কয়েন দিয়ে পানি নেয় রোগী ও স্বজনেরা। প্রতি কেজি পানি ১ টাকা করে। তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে পানির জন্য টাকা নিতে আমাদের খারাপ লাগে, কিন্তু উপায় তো নেই। পানির জন্য অধিদফতর থেকে আমাদের জন্য আলাদা কোনও বরাদ্দ নেই।’
‘পানির যে কষ্ট, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না’
এ যেন মরুভূমি এলাকায় দূর-দূরান্ত থেকে মাথায় কলস নিয়ে পানি নিতে আসা সিনেমার কোনও দৃশ্য! রাজধানী শহরে যারা হিসাব ছাড়া সুপেয় পানি ব্যবহারের সুযোগ পান, তারা নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করবেন না, পানি নিয়ে আমাদেরই দেশে এমন কষ্ট আছে। উপকূলে কোনও কোনও এলাকায় দেখা গেছে, কেবল একটি মাত্র মিঠা পানির পুকুর আছে। দূর-দূরান্ত থেকে নারীরা আসেন একাধিক কলস নিয়ে। আর যাদের সামর্থে কুলায়, তারা আসেন কয়েকজন একসঙ্গে ভ্যান ভাড়া করে।
বাংলা ট্রিবিউনের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান সরদার জানান, উপকূলের অধিকাংশ পরিবার পানি নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এখানে সুপেয় পানির খুবই অভাব। অধিকাংশ মানুষ পুকুরের পানি পান করেন। সাতক্ষীরা শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়নের ডুমুরিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার হেলেনা বিলকিস বলেন, ‘আগে আমাদের এখানে কোনও সুপেয় পানির ব্যবস্থা ছিল না। একমাস আগে ইউএনও অফিস থেকে ৫ হাজার লিটারের পানির ট্যাংকি দিয়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় এবছর এখনও পানি ধরা হয়নি। কেউ চিকিৎসা নিতে আসে ওষুধ খাওয়ার জন্য পানির দরকার হলে পরিশোধিত পুকুরের পানি পান করতে দিয়ে থাকি। তাছাড়া কী করবো? এই অঞ্চলের মানুষের পানির যে কষ্ট, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।’
বাংলা ট্রিবিউনের মোংলা প্রতিনিধি আবুল হাসান জানান, বাগেরহাটের মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে সাধারণ রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা খুবই নাজুক। হাসপাতালটিতে রোগীদের জন্য যে পরিমাণ বিশুদ্ধ পানির চাহিদা রয়েছে, তার চেয়ে সরবরাহ হচ্ছে কম। এ অবস্থায় রোগীর স্বজনরা বাইরে থেকে পানি কিনে আনেন।
বিশুদ্ধ পানির চাহিদার অভাবের কথা স্বীকার করেছেন মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য, পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শাহীন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্ট থেকে পাওয়া একটি ন্যানো ফিল্টার দিয়ে রোগীদের বশুদ্ধ পানি সরবরাহ করে হয়। তবে চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।‘
এই সংকট থেকে উত্তরণে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেও সমাধান মিলছে না। পৌরসভার লাইন থেকেও যে পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়, তাতেও সমস্যার সংকট কাটেনা এই হাসপাতালে আসা রোগীদের। তবে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জিয়াউর রহমান বলেন,‘ পুরো শ্যামনগরে সুপেয় পানির অভাব থাকলে আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পিএসএফ প্লান্ট আছে। পুকুরের পানি ফিল্টারিং করে কলের মাধ্যমে রোগীদের সুপেয় পানি নিশ্চিত করা হয়েছে। রোগীর স্বজন এবং হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট ছাড়াও এলাকার অনেক মানুষ এই পানি পান করেন।
পুকুরের পানিও একসময় খাওয়ার উপযোগী থাকে না
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগেও এক অঞ্চলের মানুষকে নির্ভর করতে হচ্ছে পুকুরের পানিতে। এমনকি বৃষ্টি না হলে, তীব্র গরম পড়লে পুকুরের পানি ঘোলাটে হয়ে যায়। তখন আর ওই পানি পানযোগ্য থাকে না। বাংলা ট্রিবিউনের খুলনা প্রতিনিধি কথা বলেন উপকূলীয় জেলা খুলনার দুর্গম ও সুন্দরবন ঘেসা কয়রা উপজেলার থানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (টিএসও) ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম এর সঙ্গে। তিনি জানান, এখানে রোগী ও স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের জন্য সুপেয় খাবার পানির কোন সুব্যবস্থা নেই। এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের খাবারপানির উৎস বলতে একটি পুকুর। এ পুকুরের পানি প্রথমে একটি চৌবাচ্চাতে তুলতে হয়। সেখানে ফিল্টারিংয়ের পর আরেকটি চৌবাচ্চাতে নিতে হয়। এরপর সেটা খাওয়া হয়। কিন্তু এ পানিও পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে একটি ফিল্টারিং ব্যবস্থা আছে। সেখান থেকে ৫০ পয়সা লিটার দরে পানি সংগ্রহ করা যায়।
‘রোগীর পানি কেন কিনে খেতে হবে’ প্রশ্নে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সব হাসপাতালে পানির ব্যবস্থা করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। যখন হাসপাতাল করবেন উপকূলীয় এলাকায় কীভাবে সুপেয় পানি দিবেন সেই পরিকল্পনা তখনই থাকতে হবে। বরাদ্দ নেই বলে কোনও কথা সেখানে থাকার সুযোগ নেই। পৌরসভা বা এনজিওর মাধ্যমে পানি আসলে সেটা তো সাময়িক। এই ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আগেই পরিকল্পনা দরকার। যখন আপনি কোথাও হাসপাতাল করবেন, তখন জরুরি যে কয়টা বিষয়ে নজর দেবেন তার মধ্যে প্রধানতম হলো পানি।’
‘কবে নাগাদ এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যাবে’ প্রশ্নের জবাবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (খুলনা সার্কেল) (অতি.দা.) মো. বাহার উদ্দিন মৃধা বলেন, ‘আমাদের কাছে বরাদ্দ আছে, কিন্তু আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা ছাড়া কাজ করতে পারি না। তারা মৌখিক নির্দেশনা দিলে তখন আমরা কাজ করতে পারি। এটি সরকারি নিয়ম। যেখানে আমাদের সাইট দেওয়া হয় সেখানেই আমরা নলকূপ স্থাপন করে দেই। এখানে সাইট না দিলে আমরা নিজে থেকে উদ্যোগ নিই না।’