X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

কামারপাড়ায় আগের ব্যস্ততা আর নেই

আসাদ আবেদীন জয়
২৭ জুন ২০২৩, ১৮:০০আপডেট : ২৭ জুন ২০২৩, ১৮:১১

কামারপাড়ায় কাছাকাছি পৌঁছাতেই কানে আসে লোহা পেটানোর শব্দ। কাঠ কয়লার আগুনে উত্তপ্ত লাল লোহায় সজোরে আঘাত করে দা, বঁটি, ছুরি, কাস্তে, কুঠারসহ বিভিন্ন লোহার সরঞ্জাম বানান কামার বা কর্মকাররা। আসন্ন ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উপলক্ষে কামারপাড়ায় এখন ব্যস্ততা বেশ। তবে এতেও মুখে হাসি নেই কামারদের। তারা বলছেন, মূলত মেশিনে তৈরি সরঞ্জামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। আগের দিনে এই সময় যে ব্যস্ততা থাকতো, আয় উপার্জন হতো; সেই তুলনায় এখনকার ব্যস্ততা কিছুই না। এখন সাধারণ সময়ে যা আয় হয়, তাতে সংসার চালানোই দায় হয়ে ওঠে তাদের।

মিরপুর ১১ নম্বর ও কাওরানবাজারের কামারপাড়া সরেজমিন ঘুরে দেখা গেলো তাদের ব্যস্ততা। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো তাদের বর্তমান জীবনচিত্র। তাদের বেশিরভাগই দীর্ঘ সময় ধরে এই পেশায়। কেউই চান না তাদের পরের প্রজন্ম এই পেশায় থাকুক। তাদের ভাষ্য, পারলে নিজেরাও পেশা ছেড়ে দিতেন। কিন্তু অন্য তেমন কোনও কাজ না জানায় একরকম নিরুপায় হয়েই পেশা ধরে রেখেছেন তারা।

১৫ বছর বয়স থেকে কামারের কাজ করেন সিরাজুল ইসলাম। বর্তমানে তার বয়স ৫০ ছুঁয়েছে। ৩৫ বছর হয়েছে তিনি এই পেশায় যুক্ত আছেন। পাঁচ মেয়েসহ সাত জনের পরিবার তার। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তিন মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। এখন তার উপার্জনেই চলছে পাঁচ জনের সংসার।

কামারদের বেশিরভাগই দীর্ঘদিন ধরেই এই পেশার সঙ্গে জড়িত। ছবি: প্রতিবেদক

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার একার আয়েই সংসার চলছে। এখন আমার সংসার চলছে দিন আনি দিন খাই অবস্থায়। প্রতিদিনের আয় প্রতিদিন করি। আমাদের মাসিক কোনও নির্দিষ্ট আয় নেই। প্রতিদিন আয় করি ১৫০০ টাকা। এরমধ্যে দুই কর্মচারীকে দিতে হয় ৯০০ টাকা, বাকি ৬০০ টাকা দিয়ে আমার সংসার চলে।’

কামারের পেশায় এখন আর আগের মতো ব্যবসা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একসময় অনেক আয় করতাম। লাখ টাকার কাজও করেছি। আবার ৫০ হাজার টাকার কাজ করলে শ্রমিকদের বেতন, কয়লার খরচ দিয়ে ৩৫-৪০ হাজার টাকা থাকতো। কিন্তু এখন আর আগের অবস্থা নাই। এখন মানুষ অনলাইনে সব কিছু অর্ডার দিয়ে কিনে ফেলে, আমাদের কাছে আর কেউ আসে না। আমরা আর বড় কাজ পাই না। ছোটখাটো কাজ করি। আবার এখন অনেক আধুনিক মেশিন আসছে, সব যন্ত্রপাতি এখন মেশিন দিয়ে কাটে। আগে এগুলো আমরা হাতে তৈরি করতাম। কামারের কাজ এখন নাই বললেই চলে। বছরের বেশিরভাগ সময় আমরা বসে থাকি। টুকটাক করে জীবন চলে।’

মেসিনে বানানো যন্ত্রপাতির সঙ্গে কঠোর পরিশ্রমের এই কাজ পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না। ছবি: প্রতিবেদক

কোরবানির ঈদের আগের ১০ দিন আয় কিছুটা বাড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই কয়দিন দৈনিক পাঁচ হাজার টাকার মতো আয় হয়। এরমধ্যে তিন শ্রমিককে দেই ২ হাজার টাকা, কাঠ কয়লায় খরচ হয় ১ হাজার টাকা, বাকি ২ হাজার টাকা আমার থাকে; এই আমার উপার্জন। তারপর সারা বছর রোজ কামাই রোজ খাই।’

৫২ বছর বয়সের আবদুল আজিজ ৪০ বছর ধরে কামারের পেশায় যুক্ত আছেন। একপর্যায়ে এসে তিনি নিজেই অনেককে কামারের কাজ শিখিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য বদলাতে পারেননি। আজিজ বলেন, ‘একসময় অনেক কাজ করেছি। এখন আর কাজ পাই না। সবাই অনলাইনে কেনাকাটা করে। মেশিনে বানানো যন্ত্রপাতির দোকানও বেড়েছে। এটাতে আমরা যারা হাতে কাজ করি, তাদের ক্ষতি হয়েছে, আয় কমেছে। এখন আমার দৈনিক গড়ে আয় হয় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। আমার সাত ছেলেমেয়েসহ ৯ জনের সংসার। বোঝেন এবার কীভাবে চলছে আমার সংসার। আমার একার আয়েই চলছে আমার সংসার।’

আজিজও জানালেন, কোরবানি ঈদের আগের কয়েকটা দিন তার উপার্জন ভালো হয়। এই কয়দিন তিনি দৈনিক গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা উপার্জন করেন। মিরপুর ১১ নম্বরের বস্তিতে তার নিজের একটি ঘর আছে। তাই তাকে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয় না। এতে তার অর্থনৈতিক কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে।

কাওরানবাজারের কামারপাড়ায় অন্যের দোকানে কাজ করেন মো. সুলতান। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত তিনি। নিজের দোকান দেওয়ার মতো অবস্থা এখনও তার হয়নি। তবে দোকান না থাকাতে ভালোই হয়েছে বলে জানান তিনি। লাভ-লসের হিসাব তাকে বইতে হয় না, কাজ করে শুধু টাকা নিয়ে যান।

লোহা পিটিয়ে দা বানাচ্ছেন এক কামার। ছবি: প্রতিবেদক

সুলতান বলেন, ‘আমি রোজ হিসেবে (দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে) কাজ করি। প্রতিদিন আমার মজুরি এক হাজার টাকা। আমি ধরতে গেলে প্রতিদিনই কাজ করি, মিস দেই না। এই ইনকামে আমার সংসার চলে যাচ্ছে। আমার পরিবারে আমি, আমার স্ত্রী আর আমাদের একটা মেয়ে আছে, ক্লাস সেভেনে পড়ে। এই তিন জনের সংসার আমার আয়ে চলে যাচ্ছে।’

মেয়েকে নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার যতদূর কুলায় আমি মেয়েকে পড়াশোনা করাবো। আমার ইচ্ছা আমার মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হোক।’

কাওরানবাজারে নিজের দোকানে কাজ করেন মো. মনির। তিনি জানান, ছুরি, কাঁচি, দা, বঁটি, কোদাল, শাবল, চাপাতিসহ লোহার যাবতীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করেন তার দোকানে। কোরবানির ঈদ আসলে তাদের ব্যস্ততা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আর ঈদ ছাড়াও নিত্যদিনের কাজের সরঞ্জাম ছুরি, কাঁচি, বঁটি এসব বিক্রি করেন তিনি।  

মনির বলেন, ‘কোরবানি ঈদ আসলে তো আমাদের কাজ অনেক বেড়ে যায়। এই সময় আয়ও মোটামুটি ভালো হয়। ঈদ ছাড়া আমার দোকান থেকে অফ সিজনেও প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার টাকা আয় হয়। পুলিশ, সেনাবাহিনী ও নার্সারির লোকেরা এসে এখান থেকে বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনে নিয়ে যায়। তাই অন্য জায়গার তুলনায় আমাদের এখানে বেচাকেনা বেশি হয়।’

ঈদের আগে পশু কোরবানির জন্য অনেকেই কিনতে আসেন লোহার যন্ত্রপাতি। ছবি: প্রতিবেদক

নিজের কামার পেশায় আসার প্রসঙ্গ তুলে মনির বলেন, ‘কথায় আছে না অভাবে স্বভাব নষ্ট, আমার হয়েছে সেই অবস্থা। আমার বাপ-দাদার কেউ এই পেশায় ছিলেন না। আমিই প্রথম এই পেশায় এসেছি। আমার ফুপার মাধ্যমেই এসেছিলাম। ১০ বছর বয়স থেকে আমি কাজ শুরু করেছি, এখনও চলছে। ঢাকায় প্রথম এসে রাস্তায় ফুটপাতেও ঘুমিয়েছি। খুব কষ্টের দিন গিয়েছে আমার। আর এই কাজটা অনেক কষ্টেরও। আমার একটা মাত্র ছেলে আছে, এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে। আমি চাই না ও কোনোভাবে এই পেশায় আসুক। আমি ওকে পড়াশোনা করাচ্ছি যাতে ভালো কিছু করে। এখানে যেন না আসে। এই পেশায় আসলে শরীরকে আগুনের তাপে পুড়িয়ে লোহার মতো করে ফেলতে হয়। আমি চাই না আমার ছেলের শরীর আমার মতো পুড়ে লোহা হয়ে যাক।’

/ইউএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ঈদের পরও চলছে রঙচটা বাস, আবার সময় দিলো বিআরটিএ
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
মুঠোফোন কানে, ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বশেষ খবর
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে