মানি লন্ডারিং সংশ্লিষ্ট ২৭ ধরনের অপরাধ অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ অনুযায়ী এমনই ছিল বিধিবিধান। যে আইনকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ (টিআইবি) সংশ্লিষ্ট সকলেই আন্তর্জাতিক মানের আইন বলে অভিহিত করেছিল। কিন্তু তিন বছরের মাথায় ২০১৫ সালে সেই আইন পরিবর্তন করে ২৭ অপরাধের মধ্যে মাত্র একটি অপরাধকে দুদকের তফসিলভুক্ত রাখা হয়। বাকি ২৬টি অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে।
গত ২০ মার্চ রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, কতিপয় লোভী মানুষের সীমাহীন প্রবণতা দেশের সব সম্ভাবনাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। হতাশার সৃষ্টি করা হচ্ছে মানুষের মধ্যে। সাধারণ মানুষও রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আশা করে। যদিও দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে দুদক নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এক্ষেত্রে দুদক তার কাজকে আরও গতিশীল করতে চায়।
২৬ অপরাধের এখতিয়ার হারানোর পর দুদকের যত উদ্যোগ
প্রো-অ্যাক্টিভ অনুসন্ধানে সুপারিশ প্রণয়নে একটি কমিটি করেছে। সার্ভেইল্যান্স, কমিউনিকেশন ইন্টারসেপশন ও আন্ডারকাভার অপারেশন পরিচালনার জন্যও কমিটি করেছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) ও এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা, মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) প্রেরণ, বিদেশি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একটি ইউনিট গঠন ও কমিটি করা হয়েছে।
ন্যাশনাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট (এনআরএ) রিপোর্ট প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেশন কমিটি ও ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, জাতীয় কৌশলপত্রের অ্যাকশন আইটেমসমূহ বাস্তবায়ন, BFIU-এর সঙ্গে সমন্বয় ও দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নসহ কমিশনের অন্যান্য কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের জন্য মানি লন্ডারিং অনুবিভাগে পৃথক ডেস্ক স্থাপন করতে কমিটি করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার হয়ে থাকে এমন দেশগুলোতে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাসমূহের সঙ্গে তথ্য, ইন্টেলিজেন্স, সাক্ষ্য-প্রমাণ আদান-প্রদান, সম্পদ ফ্রিজ, ক্রোক, বাজেয়াপ্তকরণ ও পুনরুদ্ধার কার্যকর করার জন্য দ্বিপাক্ষিক আইনি সহযোগিতা চুক্তি বা এমএলএটি করার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের নিকট প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
মানি লন্ডারিং, ব্যাংক ও বিমা সংশ্লিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত, ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং, ডিজিটাল ফরেনসিক, সার্ভেইল্যান্স ও আন্ডারকাভার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও স্টাডি ট্যুরের বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও আইসিটি অনুবিভাগ হতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে প্রেরিত এমএলএআর-এর সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা ও গৃহীতব্য ব্যবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে দুদকের অনুরোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে একজন ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে। দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত এজেন্সি টু এজেন্সি তথ্য বিনিময়ের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে যোগদানের বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে।
প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপার্স ও গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষার বরাত দিয়ে দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ৮০ ভাগ অর্থ পাচার হয় আমদানি রফতানির আড়ালে। কিন্তু তফসিলভুক্ত না থাকায় দুদক এ ধরনের অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারে না। বিদ্যমান আইনে এসব তদন্তের ক্ষমতা রয়েছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)। কর ও শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে অর্থপাচার, চোরাচালান, দেশি-বিদেশি মুদ্রাপাচারের ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দলিল-দস্তাবেজ জালকরণ, প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মানি লন্ডারিংয়ের পুরো এখতিয়ার দুদককে দেওয়ার আহ্বান টিআইবির
গত ১৭ জুলাই (২০২৩) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে ২০১৫ সালে সংশোধিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ অনুযায়ী প্রণীত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯ এর তফসিলের জরুরি সংশোধন চাওয়া হয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী যে ২৭ ধরনের অপরাধ মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা দুদকের কাছে ন্যস্ত ছিল, সেগুলো পুনরায় দুদকের এখতিয়ারভুক্ত করার দাবি জানানো হয় টিআইবির চিঠিতে।
দুদক সচিবের বক্তব্য
দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মানি লন্ডারিং আইন ২০১২ প্রথম যখন করা হয় তখন ২৭টি অপরাধের সবগুলোই দুদক করতে পারতো। পরে ২০১৫ ও ১৯ এ আইন ও বিধিমালা সংশোধন হয়। সংশোধনের পরে দুদককে শুধুমাত্র একটা অপেন্সের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেটা হচ্ছে সরকারি কর্মচারীরা যদি দুর্নীতি করে এবং মানি লন্ডারিং করে সেটা দুদক দেখতে পারবে। বাকি ২৬টা সিআইডি, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যরা করতে পারবে। এক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা অনুভব করছে দুদক। হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বিভিন্ন মামলার পর্যবেক্ষণে বিচারপতিরা বলেছেন, দুদক একটা নয়, সবগুলোই করতে পারবে। সেই পর্যবেক্ষণের আলোকে দুদক মানি লন্ডারিং আইন সংশোধন করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। এ বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। আমরা অন্য সংস্থাগুলোকে বাদ দিতে বলিনি। আমরা শুধু বলেছি, অন্য যারা করে করুক, অসুবিধা নাই। আমাদের শুধু সবগুলো অপেন্সে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যেন আমরা সবগুলো দেখতে পারি।
অন্য সংস্থাগুলো কী করছে সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য না করে দুদক সচিব বলেন, দুদক প্রথম থেকে যে কয়টা কাজ করছে, কনভিকশন রেট মোটামুটি শতভাগ। বাকী অপরাধগুলো দেখার অনুমতি পেলে তাহলে আরেকটু গতি পাবে।