X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

১৫২২ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হবে পি কে হালদারসহ ১৪ জনকে

মহিউদ্দিন খান রিফাত
০৮ অক্টোবর ২০২৩, ২০:৩৬আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ২১:৪৯

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার ওরফে পি কে হালদারের ২২ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলায় অন্য ১৩ আসামিকে পৃথক দুই ধারায় তিন ও চার বছর মিলিয়ে মোট সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুই ধারার সাজা একসঙ্গে চলবে বলে তাদের চার বছর কারাভোগ করতে হবে। তবে পি কে হালদারকে ২২ বছর সাজাই ভোগ করতে হবে। পাশাপাশি পি কে হালদারসহ সবাইকে ১ হাজার ৫২২ কোটি ৫৫ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ৬০ দিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ করতে না পারলে আসামিদের আরও ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

রবিবার (৮ অক্টোবর) ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০-এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন। এ সময় কারাগারে থাকা চার আসামি পি কে হালদারের মামাতো ভাই শঙ্খ ব্যাপারী, ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধা ও অবন্তিকা বড়াল উপস্থিতি ছিলেন। পরে তাদের পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানে হয়।

অন্যদিকে পলাতক থাকা পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার, সহযোগী অমিতাভ অধিকারী, পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, রাজীব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায় ও স্বপন কুমার মিস্ত্রির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

এর আগে গত ৪ অক্টোবর রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০-এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম রায় ঘোষণার জন্য ৮ অক্টোবর দিন ধার্য করেন।

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ৫২ মামলার মধ্যে এটি প্রথম মামলার রায়। ৫১ মামলা এখনও তদন্তাধীন।

রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মীর আহম্মেদ আলী সালাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছিলাম। এরমধ্যে শুধু পি কে হালদারকে সর্বোচ্চ দেওয়া হয়েছে। বাকি আসামিদের দুই ধারায় সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে একসঙ্গে দুই ধারার সাজা চলায় তাদের চার বছর কারাভোগ করতে হবে। তাদের সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়নি। আমরা কমিশনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেবো আপিল করার বিষয়ে।

আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহীনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সহযোগী হিসেবে ১০৯ দণ্ডবিধির কোনও উপাদান আমাদের বিরুদ্ধে ছিল না বলে মনে করি। পি কে হালদারের সহযোগী হিসেবে আমরা একটি টাকাও কোথাও খরচ করিনি। আমরা পরিস্থিতির শিকার।

তিনি বলেন, রায়ে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে আদালত অবজারভেশনে যা বলেছেন, ‘মানি লন্ডারিং দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর’ এ বিষয়ে আমার কোনও দ্বিমত নেই। আমিও এতে একমত।

যেসব ধারায় সাজা

প্রশান্ত কুমার হালদারকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৩৪৮ কেটি ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ধারা ৪(২)-এর অধীনে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৬৯৬ কোটি ৭ লাখ ৩৮ হাজার ১৮৬ টাকা জরিমানা করা হয়। পি কে হালদারকে সর্বমোট ১ হাজার ৪৪৪ কোটি ১১ লাখ ৭ হাজার ২৭৯ টাকা জরিমানা করা হয়। তার দুই ধারার সাজা আলাদাভাবে চলবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ তাকে ২২ বছর কারাভোগ করতে হবে।

এছাড়াও লীলাবতী হালদার, অবন্তিকা বড়াল, শঙ্খ বেপারী, সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধা, পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রীতিশ কুমার হালদার, রাজীব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায় ও স্বপন কুমার মিস্ত্রিকে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারাসহ দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ধারা ২৭-এর ১-এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত করে ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও প্রত্যেকের ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। মানি লন্ডারিং আইনে প্রত্যেককে চার বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুই ধারার সাজা একসঙ্গে চলবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ তাদের চার বছর কারাভোগ করতে হবে।

এছাড়াও তাদের বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা করা হয়। এরমধ্যে লীলাবতী হালদারকে ৫৪ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার ৩২৪ টাকা, অবন্তিকা বড়ালকে ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৩৫ হাজার ৪২৩ টাকা, শঙ্খ বেপারীকে ১৫ কোটি ৫০ লাখ ৪ হাজার ৯১৪ টাকা, সুকুমার মৃধাকে ১৬ কোটি টাকা, অনিন্দিতা মৃধাকে ১০ লাখ টাকা, পূর্ণিমা রানী হালদারকে ৭ কোটি ১৭ লাখ ১৪ হাজার টাকা, উত্তম কুমার মিস্ত্রিকে ৮৩ কোটি ৬৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

অমিতাভ অধিকারীকে ৬৯ কোটি ৭ লাখ ১৩ হাজার ৬১৩ টাকা, প্রীতিশ কুমার হালদারকে ১ কোটি ২ লাখ ২৯ হাজার ৯৭৯ টাকা, রাজীব শোমকে ৫৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৩০ টাকা, সুব্রত দাসকে ২ কোটি ৪৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা, অনঙ্গ মোহন রায়কে ১৩৯ কোটি ২৭ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩০ টাকা, স্বপন কুমার মিস্ত্রিকে ১৪ কোটি ৩ হাজার ১৬১ টাকা জরিমানা করা হয়।

একইসঙ্গে ৪টি ফ্ল্যাট, ৬৪১৯ দশমিক শূন্য ৫৫ শতাংশ জমি, ১১টি যানবাহন ও ৫০ লাখ টাকা এবং ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও সিটি ব্যাংক লিমিটেডের ৪১টি অ্যাকাউন্টে জমা ১ কোটি ৮৭ লাখ ৪৭ হাজার ৮৮১ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্তদের আগামী ৬০ দিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনাদায়ে আরও ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা

এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে অবন্তিকা বড়াল, শঙ্খ বেপারী, সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধা যে যতদিন জেল হেফাজতে ছিলেন সেই মেয়াদ অনুযায়ী কারাদণ্ডের সাজার মেয়াদ থেকে বাদ দেওয়া হবে। পাশাপাশি পলাতক থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার, লীলাবতী হালদার, পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রীতিশ কুমার হালদার, রাজীব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায় এবং স্বপন কুমার মিস্ত্রি সহ মোট ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

রায়ের অবজারভেশন 

পি কে হালদার ঘনিষ্ঠজনের সহযোগিতায় অসংখ্য নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে পাহাড়সম অবৈধ সম্পদ অর্জন করে উল্লেখ করে আদালত বলেন, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার দিঘিরজান গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার। তার মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার পরিবর্তে সম্পদ গড়ার নেশায় মত্ত হন। নিজের মা, আপন ভাইসহ ঘনিষ্ঠজনের সহযোগিতায় অসংখ্য নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে পাহাড়সম অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন।

নিজের সামান্য ব্যক্তিস্বার্থের জন্য মানি লন্ডারদের সহযোগী না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আদালত বলেন, একজন মেধাবী নাগরিক তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে জাতি গঠনের যে রকম ভূমিকা রাখতে পারে, ঠিক অপরদিকে অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তখন সে জাতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মানুষ ব্যক্তিস্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারের কাছে দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থ অনেক বড় ছিল। আমরা যেন নিজের সামান্য ব্যক্তি স্বার্থের জন্য মানি লন্ডারদের সহযোগী না হই।

আদালত রায়ের অবজারভেশনে আরও বলেন, যারা বিদেশে অবৈধভাবে সেকেন্ড হোম গড়েছে, তারা আসলে দেশকে ভালোবাসে না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশকে ভালোবাসতে হবে এবং আমাদের মুক্তির চেতনা নিয়ে অর্থপাচারকারীদের প্রতিহত করতে হবে।

প্রশান্ত কুমার হালদারের মতো অর্থপাচারকারীদের কোনও আদর্শ নেই উল্লেখ করে আদালত বলেন, তারা কোনও আদর্শ লালন করে না। তবে তারা অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তাদের দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করছে। প্রকৃতপক্ষে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। জাতীয় স্বার্থ ও দেশের চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে তাদের সমবেতভাবে প্রতিহত করতে হবে। ফলস্বরূপ, অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার হালদার রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে কোনও প্রকার ছাড় পাওয়ার যোগ্য নন।

উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া কোনও রাষ্ট্র একা অর্থ পাচার প্রতিরোধ করতে পারে না উল্লেখ করে আদালত বলেন, এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এখনও মুলতবি রয়েছে, যদিও এটি অনেক আগেই কানাডায় পাঠানো হয়েছিল। উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া কোনও রাষ্ট্র একা অর্থপাচার প্রতিরোধ করতে পারে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর সহযোগিতা এবং আমাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের দেশে অর্থপাচারের অপরাধ প্রতিহত করা যেতে পারে।

যে ধারায় অভিযোগ গঠন

২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০-এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের আদালত।

প্রথম অভিযোগে বলা হয়, আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার দিঘিরজান গ্রামের এক সহায়-সম্বলহীন পরিবারের সন্তান। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা অবস্থায় একজন চাকরিজীবী হিসেবে মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে আপনার নিজ নামে-বেনামে ও আপনার একান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নামে-বেনামে অসংখ্য কাগুজে কোম্পানি গড়ে তোলেন। যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, আসামি লীলাবতী হালদার, অবন্তিকা বড়াল, শঙ্খ বেপারী, সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধা, পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রীতিশ কুমার হালদার, রাজিব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায় এবং স্বপন কুমার মিস্ত্রি আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারকে অবৈধ পন্থায় মোট ৪২৫ কোটি ৯৬ লাখ ২৯ হাজার ১৪০ টাকা আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে সহযোগিতা করেছেন। যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা/ পেনাল কোডের ১০৯ ধারায় শান্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার নিজ নামে-বেনামে এবং আপনার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানি/কাগুজে কোম্পানি/ব্যক্তির নামে-বেনামে ৪টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় মোট ১৭৮টি ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করেন। বর্ণিত ১৭৮টি হিসাবে ২০২১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত গত ১২ বছরে মোট ৬ হাজার ৮০ কোটি ৮৬ লাখ ৪০ হাজার ১২৫ টাকা জমা করেন এবং ৬ হাজার ৭৬ কোটি ৫১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৫৯ টাকা উত্তোলন করেন। ৪টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় পরিচালিত ১৭৮টি হিসাবের বেশিরভাগই আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের প্রকৃত অবস্থান গোপন করার হীন উদ্দেশ্যে নিজ নামে-বেনামে, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাগুজে কোম্পানি এবং একান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নামে রাখা হয়।

আসামি অবন্তিকা বড়াল, শঙ্খ বেপারী, অমিতাভ অধিকারী, পূর্ণিমা রাণী হালদার, অনঙ্গ মোহন রায়, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, অনিন্দিতা মৃধা, রাজিব সোম, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, প্রীতিশ কুমার হালদার ও আপনার মা আসামি লীলাবতী হালদারের নামে-বেনামে অসংখ্য ব্যাংক হিসাব খুলে অসংখ্য আন্তলেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ অর্জিত অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে পরস্পর যোগসাজশে মানি লন্ডারিং করেছেন। আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার ছোট ভাই প্রীতিশ কুমার হালদারের মাধ্যমে হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে কানাডাতে ওই অর্থ পাচার করেছেন। যা দ্বারা আসামিরা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

আদালতে অভিযোগ পড়ে শোনানো হলে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা অবন্তিকা বড়াল, শঙ্খ বেপারী, সুকুমার মৃধা ও অনিন্দিতা মৃধা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান। তারা তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন। পি কে হালদারসহ ১০ আসামি পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে শুনানি হয়নি। পরে আদালত অব্যাহতি চাওয়া চার আসামির আবেদন নামঞ্জুর করে এবং আদালতে হাজির না থাকা ১০ জনকে পলাতক দেখিয়ে ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরুর আদেশ দেন।

মামলার এজাহার ও চার্জশিট 

২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। মামলার এজাহারে বলা হয়, পি কে হালদার বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ নিজ দখলে রেখেছেন। এছাড়া ওই অর্থ আড়াল করতে বিদেশে পাচার করে মানি লন্ডারিং আইনেও অপরাধ করেন তিনি।

পরে মামলাটি তদন্ত শেষে ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক সালাহউদ্দিন। চার্জশিটে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে ৯৩৩ কোটি টাকার জমি, ফ্ল্যাট ও হোটেল ক্রয় করেন পি কে হালদার। এরমধ্যে জমি কিনেছেন ৬ হাজার ৭৯০ শতাংশ। এই সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকা। নিজের নামে তিনি জমি কিনেছেন ৪ হাজার ১৭৪ শতাংশ। দলিলে এসব জমির দাম ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত বাজারমূল্য প্রায় ২২৮ কোটি টাকা। এছাড়া ধানমন্ডিতে তার নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

চার্জশিটে আরও বলা হয়, পি কে হালদার তার নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদারের নামে উত্তরায় একটি ভবন নির্মাণ করেন, যার দাম প্রায় ১২ কোটি টাকা। পূর্ণিমার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রির নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রিন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি কেনেন, যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা। পি কে হালদার কাগুজে কোম্পানি ক্লিউইস্টোন ফুডসের নামে কক্সবাজারে দুই একর জমির ওপর র‌্যাডিসন নামে আটতলা হোটেল নির্মাণ করেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪০ কোটি টাকা। তার খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী ও অনঙ্গ মোহন রায়ের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪০৪ শতাংশ জমি কেনেন, যার দাম প্রায় ১৬৭ কোটি টাকা।

ভারতে আটক পি কে হালদারসহ ছয় জন

২০২২ সালের ১৪ মে কলকাতার অশোকনগরসহ পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় অভিযান চালিয়ে পি কে হালদারকে গ্রেফতার করে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। একই সঙ্গে তার ভাই প্রাণেশ হালদার, স্বপন মিস্ত্রি ওরফে স্বপন মৈত্র, উত্তম মিস্ত্রি ওরফে উত্তম মৈত্র, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার এবং আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদারসহ বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়।

গত ১১ জুলাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কলকাতার আদালতে চার্জশিট জমা দেয় ইডি। অর্থপাচার আইন-২০০২ এবং দুর্নীতি দমন আইন- ১৯৮৮’র বিভিন্ন ধারায় অভিযুক্তদের নামে চার্জ গঠন করা হয়। বর্তমানে পি কে হালদারসহ পাঁচ পুরুষ আসামি রয়েছেন প্রেসিডেন্সি কারাগারে। আর একমাত্র নারী আসামি আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদার রয়েছেন আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।

আরও পড়ুন-

পি কে হালদারের ২২ বছর কারাদণ্ড

যারা বিদেশে অবৈধভাবে সেকেন্ড হোম গড়েছে তারা দেশকে ভালোবাসে না

/এফএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: বিচারের অপেক্ষায় এক দশক পার
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সর্বশেষ খবর
কেন ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা?
কেন ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা?
অটোরিকশার ধাক্কায় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে শিশুর মৃত্যু
অটোরিকশার ধাক্কায় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে শিশুর মৃত্যু
উন্নয়নের ভেলকিবাজিতে বাংলাদেশ এখন ডেথ ভ্যালি: রিজভী
উন্নয়নের ভেলকিবাজিতে বাংলাদেশ এখন ডেথ ভ্যালি: রিজভী
ময়মনসিংহে বাস-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ, দম্পতি নিহত
ময়মনসিংহে বাস-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ, দম্পতি নিহত
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?