X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১
কাজে আসছে না ডিএমপির উদ্যোগ

রাজধানীর সড়কে রাতভর বেপরোয়া ছিনতাইকারীরা

নুরুজ্জামান লাবু
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০:৪০আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০:৪০

রাত যত গভীর হয়, রাজধানীর সড়কে কমতে থাকে যানবাহন। এই সুযোগে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারীরা। তারা মোটরবাইক ও প্রাইভেট কার নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় শহরের বিভিন্ন সড়ক-অলিগলি। এ সময় তাদের শিকার হয় রিকশাযাত্রী বা পথচারীরা। কখনও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনিয়ে নেয় টাকা, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী। আবার কখনও ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ব্যাগ। এমন কর্মকাণ্ড চলে ভোর অবধি। তারপর আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আড়ালে চলে যায় তারা।

রাতভর ছিনতাইয়ের ‘মহোৎসব’ ঠেকাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। মাসে মাসে বৈঠক আর ছিনতাই দমনে নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা হলেও ছিনতাই কমছে না।

এমনিতেই রাতের ঢাকায় পুলিশি টহল নেই বললেই চলে। সড়কের কোথাও কোথাও গতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যারিকেড স্থাপন করা হয়। কোথাও কোথাও পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সন্দেহভাজনদের তল্লাশিও করা হয় না। ছিনতাইকারীরা পুলিশের টহল এড়িয়ে ছিনতাই করে বেড়ায়।

যা বলছেন ভুক্তভোগীরা
গত ২ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকা বঙ্গভবনের সামনের সড়কে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন দৈনিক ইনকিলাবের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল। পুরান ঢাকার বাসায় ফেরার পথে মোটরসাইকেলযোগে আসা দুই ছিনতাইকারী তার রিকশার গতিরোধ করে। তাকে চাপাতির ভয় দেখিয়ে সঙ্গে থাকা ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যায়।

এ বিষয়ে মাইনুল হাসান সোহেল জানান, তিনি ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্টাফ জারিফসহ রিকশায় করে বঙ্গভবনের সামনের সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে দুই ছিনতাইকারী এসে তাদের গলায় চাপাতি ধরে টাকাপয়সা নিয়ে নেয়। ছিনতাইকারীরা তখন আরও কয়েকটি রিকশা আটকে কয়েকজনের মালামাল ছিনতাই করে। ঘটনাস্থলের আশপাশে পুলিশের কোনও টহল ছিল না।

তিনি আরও জানান, গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি তিনি একই জায়গায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিলেন। তখন ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার আইফোন ও নগদ কয়েক হাজার টাকা নিয়ে নেয়। পরে মতিঝিল থানায় একটি অভিযোগ করলেও, আজও কাউকে গ্রেফতার বা মোবাইল উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস.) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, ছিনতাই প্রতিরোধে টাস্কফোর্স গঠন করার পাশাপাশি আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। কিন্তু আদালতের মাধ্যমে তারা জামিনে বের হয়ে এসে আগের মতো ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে।

সম্ভব নয় জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকায় এত মানুষের বসবাস যে এখানে ছিনতাই পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমরা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। পুলিশের টহল-চেকপোস্ট সবই বাড়ানো হয়েছে। ছিনতাইকারীদের প্রধান টার্গেট হলো মোবাইল ফোন। আমরা তা উদ্ধারও করি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত রাত ১০টার পর থেকেই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বেপারোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারী চক্র। একটি মোটরসাইকেলে দুজন ছিনতাইকারী ধারালো বা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন সড়কে ঘুরতে থাকে। যেসব সড়কে যানবাহন কম থাকে এবং পর্যাপ্ত আলো থাকে না, সেসব এলাকার রিকশাযাত্রী বা পথচারীদের টার্গেট করে তারা। চক্রটি এক জায়গায় ছিনতাই শেষে অন্য সড়কে চলে যায়। একই কৌশল অবলম্বন করে প্রাইভেট কারযোগে ছিনতাই করা চক্রটিও।

রাতের টহল-চেকপোস্টে গা-ছাড়া ভাব
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে রাতভর সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ এলাকাতেই পুলিশের টহল ও চেকপোস্টে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন পুলিশ সদস্যরা। টহল গাড়িতে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যরা এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা দূরে বসে থাকেন। কখনও কখনও তারা রিকশাযাত্রীদের তল্লাশি করতে দেখা গেলেও, ছিনতাইকারীদের মোটরসাইকেল বা প্রাইভেট কারকে তল্লাশি করা হয় না।

অবশ্য ডিএমপির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলছেন, রাজধানীতে রাতের বেলায় যত যানবাহন চলাচল করে, তার সব কটি তল্লাশি করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া ছিনতাইকারীরাও টহল গাড়ি বা চেকপোস্ট আছে, এমন জায়গাগুলো এড়িয়ে চলে।

উবার-পাঠাওয়ের নাম ব্যবহার
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর সড়কে অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার বেড়ে যাওয়ায় ছিনতাইকারীরা এর সুযোগ নিচ্ছে। টহল পুলিশ বা চেকপোস্টে তাদের তল্লাশি করলে তারা উবার-পাঠাওয়ের যাত্রী পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে। এটা শুনে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তল্লাশি না করেই তাদের যানবাহন ছেড়ে দেন। এ ছাড়া হাতেনাতে গ্রেফতার বা তল্লাশিতে যানবাহনে বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছে কোনও ধরনের ধারালো অস্ত্র বা আগ্নেয়াস্ত্র না পেলে আটক করাও সম্ভব হয় না।

টার্গেট বাস রেল নৌ টার্মিনাল
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ছিনতাইকারীদের ভাষায় তাদের কাছে উত্তম সময় হলো ভোর। এ সময় বাস, রেল ও নৌ টার্মিনালে যাত্রীরা এসে নামে। ভোরের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যাত্রীরা আসার সময় ছিনতাইকারীরা তাদের টার্গেট করে। এদিকে রাতভর দায়িত্ব পালন শেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তখন গা-ছাড়া ভাব নিয়ে থাকেন। ফলে এই সময়টাতেই বেশি সক্রিয় থাকে ছিনতাইকারীরা।

তারা জানান, আবার সকালে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় কর্মজীবী নারী-পুরুষরা যখন বের হন, তখনও ওঁত পেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার নিয়ে তাদের ব্যাগ ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া কিংবা পথ আটকে স্বর্বস্ব কেড়ে নেয় চক্রটি।

ছিনতাই বেশি, মামলা কম, উদ্ধারও কম
রাজধানীতে প্রতিদিন একাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও থানায় মামলার সংখ্যা কম। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ছিনতাইকারীরা কম দামী মালামাল নিলে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চান না। কেউ কেউ শুধু সাধারণ ডায়েরি করেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, ছিনতাইয়ের খপ্পরে পড়ে থানায় গিয়ে মামলা করতে চাইলে পুলিশ নিতে চায় না। মামলা করলে কোর্ট-কাছারিতে দৌড়াতে হবে, এমন ভয় দেখিয়ে তারা জিডি করতে উৎসাহিত করে। জিডিতে সাধারণত সঙ্গে থাকা সামগ্রী হারিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করতে হয়। ফলে এসব জিডির তদন্তে তারাও আর গুরুত্ব দেয় না।

মনিটরিং সেলের বৈঠকে হতাশা প্রকাশ
ডিএমপির গুরুত্বপূর্ণ মামলার মনিটরিং সেলের আলোচানার কার্যবিবরণী ঘেঁটে দেখা গেছে, সম্প্রতি যতগুলো ছিনতাই বা দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে, বেশির ভাগেরই রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা।

গত ২৮ ডিসেম্বর ছালাম নামে সৌদিপ্রবাসী এক ব্যক্তি বিমানবন্দর থেকে ডেমরার সারুলিয়ায় যেতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। চক্রের সদস্যরা একটি মাইক্রোবাস নিয়ে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে প্রবাসীর গাড়ি আটকে প্রায় ১৮ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়ে যায়। এ ঘটনায় প্রবাসী মামলা করলেও এখনও রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

গুরুত্বপূর্ণ মামলার মনিটরিং সেলের সর্বশেষ মিটিংয়ে বিষয়টিতে হতাশা প্রকাশ করে বলা হয়, একই ঘটনাস্থলে পরপর তিনটি ঘটনা ঘটেছে। একটিরও রহস্য উদঘাটন করা হয়নি। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে না পারলে, অচিরেই আরও ঘটনা ঘটবে।

গত ১ ডিসেম্বর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সামনে মাহমুদা বেগম নামে এক নারী দিনদুপুরে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। মোটরসাইকেলযোগে দুই ছিনতাইকারী রিকশায় থাকায় ওই নারীর ব্যাগ ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। সে ঘটনার রহস্যও উদঘাটন করতে না পারায় মনিটরিং সেলের বৈঠকে হতাশা প্রকাশ করে বলা হয়, ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে টানা পার্টির (ছিনতাই চক্র) দু-একজনকে গ্রেফতার করতে পারলে ঘটনা পুনরায় ঘটবে না। থানার টহল পার্টিকে আরও তৎপর থাকার নির্দেশের পাশাপাশি যেকোনও উপায়ে এদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

ডিএমপির দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা বলেন, ছিনতাই প্রতিরোধে সার্বিকভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরাধবিজ্ঞানের ভাষায় ক্রাইম অপারচুনিটি না কমিয়ে আনলে এটি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। রাজধানীতে যেসব এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে, সেসব এলাকায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা; ঢাকার প্রধান সড়কগুলোয় সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা, গ্রেফতার হওয়া ছিনতাইকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা, ছিনতাইকারী হিসেবে গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে বেরিয়ে এলে তাদের নজরদারি করাসহ অনেক কাজ একসঙ্গে করতে হবে। তাহলেই ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

শুধু ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটার পর আসামি গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধারের দিকে মনোযোগ বেশি দিলে অপরাধ কমানো যাবে না বলে মনে করেন তিনি।

/এনএআর/
সম্পর্কিত
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
মিল্টন সমাদ্দার আটক
রিমান্ড শেষে কারাগারে ‘কেএনএফের’ ১৩ সদস্য, আরেক নারী গ্রেফতার
সর্বশেষ খবর
হজ এজেন্সিগুলোর কথার সঙ্গে কাজের কোনও মিল নেই: ধর্মমন্ত্রী
হজ এজেন্সিগুলোর কথার সঙ্গে কাজের কোনও মিল নেই: ধর্মমন্ত্রী
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
টিভিতে আজকের খেলা (২ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২ মে, ২০২৪)
ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!