বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও টান থেকেই শুরু হয় বইমেলা। প্রথমে ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু হলেও কালক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। সাহিত্যপ্রেমী মানুষের আগমনে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে তা। একুশে বইমেলা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাহিত্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশে মানুষের পছন্দের অন্যতম ক্ষেত্র অনুবাদ সাহিত্য। প্রকাশকরা জানান, অনুবাদ সাহিত্যের চাহিদা ক্রমশই বাড়ছে।
অমর একুশে বইমেলার ২৫তম দিন রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, অনুবাদ সাহিত্যের স্টলগুলোতে প্রচুর ভিড়। তবে অনুবাদ সাহিত্যের মান আরও ভালো হওয়া উচিত বলে মনে করেন পাঠকরা।
পাঠকরা জানান, অনেক সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ ইংরেজির চেয়ে দুর্বোধ্য। দেশে অনুবাদ সাহিত্যের চাহিদা বাড়ছে। সেক্ষেত্রে প্রকাশকদের উচিত এর মানের দিকে নজর দেওয়া। তা না হলে এই চাহিদা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনুবাদকদেরও পেশাদারি অনুবাদের দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেন তারা।
প্রকাশকরা জানান, মান নিশ্চিতের জন্য লেখকের পাশাপাশি, প্রকাশকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনুবাদক অনুবাদ করে পান্ডুলিপি জমা দেওয়ার পর নিজস্ব সম্পাদনা পর্ষদের মাধ্যমে সম্পাদনা করা উচিত। আর তা না থাকলে যারা ফ্রিল্যান্স সম্পাদনা করে, তাদের দিয়ে সম্পাদনা করানো যেতে পারে। তাহলে মান আরও বাড়বে। নয়তো কোনও লেখা পড়ে কেউ না বুঝলে তা মান হারাবে।
ভূমি প্রকাশে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সাহেদা রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, একাদশ শ্রেণি থেকেই তিনি অনুবাদ সাহিত্যে পড়তে শুরু করেন। বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা থ্রিলার লেখকদের বইয়ের অনুবাদগুলো পড়েন। কিন্তু কিছু কিছু অনুবাদ ইংরেজির চেয়েও কঠিন। এ বিষয়ে প্রকাশকদের নজর দেওয়া দরকার।
সেবা প্রকাশে এসে তিন গোয়েন্দা সিরিজের দশটি সংখ্যা কিনেছেন নুসাইবা মাহি। তিনি বলেন, পরিবারের কারণেই অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক তার। পাশাপাশি মৌলিক সাহিত্যও পড়েন। তিনি জানান, দেশে অনুবাদের পাঠক বাড়ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। যার কারণে অনেকেই অনুবাদের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু অনেকে মান ঠিক রাখতে পারছেন না। এগুলোর প্রতি প্রকাশকদের মনোযোগ দিতে হবে।
গ্রন্থরাজ্যের বিক্রয়কর্মী লাভলু বলেন, অনুবাদ সাহিত্যের চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আমাদের অনুবাদ বইগুলো ভালো বিক্রি হচ্ছে।
ভূমি প্রকাশের প্রকাশক জাকির হোসাইন বলেন, আমাদের দেশে অনুবাদের পাঠক বাড়ছে, এটি সাড়া জাগানো বিষয়। মান নিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে প্রকাশকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনুবাদের বই প্রকাশের পর যদি পাঠক তা পড়ে বুঝতে না পারে, তাহলে সে অনুবাদ ব্যর্থ। সে জন্য বই অনুবাদের পর পান্ডুলিপি নিজস্ব সম্পাদক দিয়ে সম্পাদনা করতে হবে। আর যদি তা না থাকে তাহলে ফ্রিল্যান্স সম্পাদকদের দিয়ে সম্পাদনা করে নেওয়া যেতে পারে। তাহলে সাবলীল বাংলায় হবে এবং যে কেউ পড়ে বুঝতে পারবে।
বাংলাদেশে অনুবাদের আগমন সেবা প্রকাশনীর হাত ধরে। অনুবাদ সাহিত্যের মান নিয়ে প্রকাশনাটির ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, অনুবাদ সাহিত্যের চাহিদা সব সময়ই বাড়তি। এটি সামনে আরও বাড়বে। তবে কেউ হয়তো ইংরেজি সাবলীলভাবে পড়তে পারেন না। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁক আছে। অনুবাদ পড়ে যদি তারা তা বুঝতে না পারে তাহলে তো মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সেবা সেটি নিশ্চিত করেই বই প্রকাশ করে। সেবা প্রকাশনী ট্রায়ালে রেখে অনুবাদক তৈরি করে বলেও জানান তিনি।
তরুণ অনুবাদ সাহিত্যিক আহমেদ সাদ বলেন, মান নিয়ে প্রকাশকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। দেখা যায়, অনুবাদক অনুবাদ করার পর প্রকাশক নিজে দুই তিনবার দেখেই বইটা ছাপিয়ে দেয়। প্রকাশক যদি সম্পাদক প্যানেল দিয়ে সম্পাদনা করে তাহলে মান আরও বাড়বে। এ বিষয়টি তাদের খেয়াল রাখতে হবে।
নতুন বই
অমর একুশে বইমেলার ২৫তম দিন রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) নতুন বই এসেছে ৯৬টি।
মূল মঞ্চের আয়োজন
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাজী নূরুল করিম দিলু। আলোচনায় অংশ নেন তানভীর নেওয়াজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জেবুন নাসরীন আহমেদ।
প্রাবন্ধিক কাজী নুরুল কবির দিলু বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের কর্মপরিধি ছিল বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম গেরিলা সদস্য হিসেবে একের পর এক দুঃসাহসিক অপারেশনে অংশ নিয়েছেন তিনি। তার পরিকল্পিত নকশায় নির্মিত হয়েছে দেশের অনেক দৃষ্টিনন্দন ভবন ও স্থাপনা। গণমানুষের অধিকারের বিষয়ে মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন আপসহীন। দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভবন সুরক্ষা, পরিবেশ রক্ষা, শিক্ষা, ক্রীড়া এমনকি ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা থেকে শুরু করে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি রেখেছেন সক্রিয় ভূমিকা। সর্বোপরি, সফলতা ও ব্যর্থতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি মানবকল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক জেবুন নাসরীন আহমেদ বলেন, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল দৃঢ়তা, সততা, সাহসিকতা এবং দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। তার কর্মমুখর জীবন ও আদর্শ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
লেখক বলছি
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, কথাসাহিত্যিক জসিম মল্লিক, কবি শিবলী মোকতাদির, নাট্যকার খায়রুল বাসার এবং শিশুসাহিত্যিক উৎপলকান্তি বড়ুয়া।
বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন
এই মঞ্চে বিকাল ৫টায় কবি ও চলচ্চিত্রকার মাসুদ পথিকের কবিতা ও চলচ্চিত্র বিষয়ে তার সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি এজাজ ইউসুফী, জান্নাতুল ফেরদৌসী, উৎপলকান্তি বড়ুয়া, অংকিতা আহমেদ রুবি, রিশাদ হুদা, সৌমিত্র দেব, অরবিন্দ চক্রবর্তী, আহসান মালেক, রওশন ঝুনু, সমর চক্রবর্তী, গিরিশ গৈরিক এবং আহমেদ জসিম। ছড়া পাঠ করেন আখতার হুসেন, আমীরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন, ফারুক হোসেন, আনজীর লিটন, মাহমুদউল্লাহ, সারওয়ার উল আলম, রিফাত নিগার শাপলা এবং তপংকর চক্রবর্তী। আবৃত্তি করেন মাহমুদা আখতার, চিং হ্লা মং চৌধুরী এবং চৌধুরী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
সোমবারের কর্মসূচি
২৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার অমর একুশে বইমেলার ২৬তম দিন। মেলা শুরু হবে বেলা ১২টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: আবুবকর সিদ্দিক’ এবং ‘স্মরণ: আজিজুর রহমান আজিজ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন যথাক্রমে ফরিদ আহমদ দুলাল এবং কামরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মামুন মুস্তাফা, তৌহিদুল ইসলাম, মো. মনজুরুর রহমান এবং আনিস মুহম্মদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন কবি আসাদ মান্নান।