ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন ‘একাই একশ’, কার্যত তারা দেশের রাজনীতিতে ‘একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারকারী’ দলে পরিণত হয়েছে– এরকম ধারণা পোষণ করছেন ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের ‘একলা চলো’ নীতির কারণে জোটের আগের মতো আর চোট নেই। এ নিয়ে শরিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের মাঝে বিস্তর ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। তারা মনে করছেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় মুখ খুলে কোনও লাভ হবে না, বরং ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।
একান্ত আলাপচারিতায় ১৪ দলের অন্তত পাঁচটি দলের আট নেতার ভাষ্য, ১৪ দল এখন ২০ বছরের (২০০৪-২০২৪) বুড়ো জোটে পরিণত হয়েছে, যা কার্যত খুঁড়িয়ে চলছে। নতুন নির্বাচনি বাস্তবতায় জোট-মহাজোটের রাজনীতির প্রভাব কমে আসছে। ফলে কাগজে-কলমে ১৪ দলীয় জোট থাকলেও আগের মতো আর চোট নেই। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে ১৪ দলের সক্রিয়তা ক্রমে চক্রবৃদ্ধি হারে কমেছে। শরিক দলগুলো এই বাস্তবতা ও পরিস্থিতি বুঝতে পারছে বলেই অনেকটা চুপ হয়ে গেছে। জোটের রাজনীতি রেখে দলীয় রাজনীতি করছে দলগুলো। কেউ কেউ এর মধ্যেই যেভাবে পারছে সুবিধা নিচ্ছে।
১৪ দলের নেতাদের পর্যবেক্ষণ— বিএনপি তাদের পুরনো ২০ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা নতুন জোট গঠন করে রাজপথে নামলে আওয়ামী লীগও আবার ১৪ দলীয় জোট বা মহাজোট সক্রিয় করবে। এর বাইরে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যে যুগপৎ আন্দোলন করছে, তা দানা বাঁধলেও ১৪ দলের তৎপরতা দৃশ্যমান করতে পারে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ, ১৪ দলীয় জোট থাকা না থাকা অথবা সক্রিয় করা না করার বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ও আওয়ামী লীগের ওপর। তবে ১৪ দলীয় জোট টিকে থাকলেও কিংবা সক্রিয় হলেও আগের ‘যৌবন’ আর কখনও ফিরবে না বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১৪ দলের বৈঠক হয় না অনেক দিন। কবে হবে তাও জানি না, আওয়ামী লীগ জানে। জোটের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ না পেলে তো মিটিং ডাকেন না। আগে কথা বলতাম, তখন ১৪ দলের ফাংশনিং ছিল। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী কথা বলতাম, সমালোচনা করতাম। এখন ১৪ দলের গুরুত্ব মনে হয় আওয়ামী লীগ ফিল করছে না। ১৪ দল আরও সক্রিয় হলেও আগের অবস্থা আর ফিরবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে ২০০৪ সাল থেকে ২৩ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনে নামে ১৪ দলীয় জোট। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শের ভিত্তিতে গড়া এই জোটকে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করে ১৪ দল।
পরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে মিলে মহাজোট গড়ে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। মহাজোট সরকারের সময় ১০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত ১৪ দলের কর্মসূটি কমে আসলেও ধারাবাহিকতা ছিল। জাতীয় পার্টির (জাপা) পাশাপাশি ১৪ দলের শরিক তিনটি দলের তিন জন মন্ত্রী হয়েছেন। তারা হলেন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের হাসানুল হক ইনু ও সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া।
জাতীয় পার্টি-জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একভাবে দেখলে ১৪ দলীয় জোট এখন নিষ্ক্রিয় বলা যায়। জোটের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। সে কারণে জোটগতভাবে কোনও বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে না। তাই আমরাও অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছি। এখন ১৪ দলকে সক্রিয় করবে কি করবে না, সেটা আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ১৪ দলীয় জোটের সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে থাকে। ওই সময়ে জোটের তিন জন শরিক নেতা মন্ত্রিসভায় স্থান পান। তারা হলেন— ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের হাসানুল হক ইনু ও জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তবে আওয়ামী লীগ আবার ১৪ দলের পাশাপাশি জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিয়ে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় পেয়ে সরকার গঠন করে। ওই সরকারে ১৪ দলের কোনও শরিক নেতা মন্ত্রিত্ব পাননি। জাতীয় পার্টিকেও মন্ত্রিসভার বাইরে রাখা হয়। বিরোধী দলের ভূমিকায় যায় জাপা।
আরও পড়ুন- মাঠে একাই আওয়ামী লীগ, সঙ্গে নেই ১৪ দল
সবশেষ গত ৫ বছরে ১৪ দলীয় জোটের বৈঠক হয়েছে দেড় ডজনের মতো। এসব বৈঠকের সিংহভাগই হয়েছে জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর বাসায়। সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে কয়েকটি সমাবেশ হয় ১৪ দলের ব্যানারে। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে জোট নেতাদের সঙ্গে চারটি হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে। তবে গত নির্বাচনের পর ১৪ দলের জোটগত কর্মসূচি নেই এখন পর্যন্ত, এমনকি বৈঠকও হয়নি সেভাবে।
জোটের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নেত্রী বলে দিয়েছেন, ১৪ দলীয় জোট আছে, থাকবে। আদর্শিক কারণে ১৪ দল আমরা একই আছি। জনগণের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে দলের পক্ষ থেকে বা ১৪ দলের পক্ষ থেকে আরও জোড়ালোভাবে অবস্থান নেওয়া দরকার। শুধু চুপ করে বসে থাকা না, কর্মসূচি নেওয়া দরকার। আমরা আগেও ন্যায্য কথা বলেছি, যেটা অন্যায্য সেটার সমালোচনা করেছি, এখনও বলছি এবং করছি। লুটপাট-দুর্নীতি, ব্যাংক ডাকাতিসহ এই ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও আমাদের কথা বলতে হবে।
অপর দিকে, ১৪ দলের শরিক দল থেকে নবম জাতীয় নির্বাচনে (২০০৮) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন চার জন, দশম সংসদে (২০২৪) সংরক্ষিত দুই জনসহ ১৩ জন, একাদশ সংসদে (২০১৮) আট জন, দ্বাদশ সংসদে (২০২৪) যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র দুই জনে। এ ছাড়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকদের ১৬টি আসনে আওয়ামী লীগ ছাড় দিলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেয় ছয়টি। তবে আওয়ামী লীগের ছাড় দেওয়া আসনগুলোতে দুটি ছাড়া বাকিগুলোতে দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরেছেন শরিক দলের প্রার্থীরা। এমন ফলাফলের আশঙ্কায় ভোটের আগেই ছাড় দেওয়া আসনগুলো থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরিয়ে দিতে আওয়ামী লীগকে অনুরোধ করলে সাড়া মেলেনি।
বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বলেন, ১৪ দলীয় জোট অবশ্যই আছে। ১৪ দলীয় জোট একটি আদর্শিক জোট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় আমাদের সমন্বয়ে এই জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। যতক্ষণ ১৪ দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজন মনে করবেন ততক্ষণ ১৪ দলীয় জোট থাকবে, না চাইলে থাকবে না। এই ব্যাপারে অন্য কোনও নেতার কোনও কথাই গ্রহণযোগ্য হবে না। আমি মনে করি, ১৪ দলীয় জোটের এখনও প্রয়োজনিয়তা আছে। বৈশ্বিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৪ দলীয় জোটের কোনও বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেন, ১৪ দলীয় জোট নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগ নিচ্ছে বিরোধীরা। সরকারি দলের লোকজন জোটকে সক্রিয় করছে না। এই অবস্থার পেছনে শরিক দলগুলোর মাঝে অনৈক্যও একটা কারণ। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে জোটের এমন অবস্থা হতো না। বিরোধীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তাই জোটকে দ্রুত সক্রিয় করা দরকার। এই বাস্তবতাও আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে, এতেই সবার মঙ্গল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৪ দলীয় জোটকে প্রথম ১০ বছর (২০০৪-২০১৪) রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় দেখা গেছে। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারের নেতিবাচক নানা কর্মকাণ্ডের জোর সমালোচনাও করতে দেখা গেছে জোট নেতাদের। পরের ১০ বছরে (২০১৪-২০২৪) ধারাবাহিকভাবে ক্রমাগত ১৪ দলের রাজনীতি হ্রাস পেতে থাকে। এই সময়ের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ ও সরকারের নেতিবাচক নানা কর্মকাণ্ডের কিছু সমালোচনা করলেও শেষ দিকে অনেকটাই নীরব হয়ে গেছেন শরিক নেতারা। শরিক দলগুলো দিবসকেন্দ্রিক এককভাবে কিছু কর্মসূচি পালন করলেও রাজনীতির মাঠে সাড়া মিলছে না। ফলে ১৪ দল টিকে থাকলেও জোটের রাজনীতিতে চোট নেই।
আরও পড়ুন- ১৪ দলের ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে যা বলছেন শরিক নেতারা
১৪ দলের শরিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, বিএনপি-জামায়াতকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসতে ১৪ দলের প্রয়োজন ছিল আওয়ামী লীগের। এরপর টানা চার মেয়াদে দলটি ক্ষমতায় থাকায় দেশের রাজনীতিতে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করছে। সে কারণে সময়ের সঙ্গে জোটের শরিক দলগুলোর প্রয়োজন এখন প্রায় ফুড়িয়ে গেছে আওয়ামী লীগের কাছে। এ জন্য ‘একলা চলো নীতি’ নিয়ে এগুচ্ছে দলটি। এ ছাড়া সরকারবিরোধী দলগুলোও জোট রেখে সমমনা দলগুলো নিয়ে যুগপত আন্দোলন করায় ১৪ দলীয় জোটকে সক্রিয় করছে না আওয়ামী লীগ। সে কারণে জোট নেতারা কালেভদ্রে জোটের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর বাসায় গিয়ে চা-নাশতা খেয়ে ক্ষোভের কথা জানাচ্ছেন। কিন্তু তাতে আওয়ামী লীগ কান না দেওয়ায় ভবিষ্যতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা তাদের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১৪ দলের শরিক দলগুলো আওয়ামী লীগের জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছে। তারা বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলায় মাঠে নামে না। সরকারে থেকে, সংসদে থেকেও সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে পারেনি, বরং আরও কমেছে। দলীয় রাজনীতিটাও সেভাবে করছে না। সুযোগ-সুবিধা নো নিচ্ছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জোট-মহাজোট গুরুত্ব হারাচ্ছে। এখানে আওয়ামী লীগের দোষ কোথায়?
১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র, সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, ১৪ দলীয় জোট আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে এবং সেভাবেই চলছে। এই জোট আছে এবং থাকবে— এ কথা তো আমাদের নেত্রী বলেছেন। জোটের শরিক দলগুলো নিজেদের মতো করে রাজনীতি করছে।
শুক্রবার (৩ মে) ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিরোধী দলের মোকাবিলায় আমাদের সুসংগঠিত হতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ১৪ দলীয় জোটকেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে কাছে টানতে হবে। সব কিছু মিলিয়ে আমাদের নিজেদের সাবজেক্টিভ প্রিপারেশনের ওপর নির্ভর করে আমরা বাস্তব কঠিন পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে সক্ষম।