যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রয়োজন আইনের সংশোধন ও পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন। আইনে পরিপূর্ণভাবে প্রতিটি কথা সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে। অপরাধের সংজ্ঞা, অপরাধের গুরুত্ব বর্ণনা করতে হবে। তদন্ত প্রক্রিয়া কত দিনে, কী প্রক্রিয়ায় করা হবে ও তদন্ত প্রতিবেদন কত দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে তা সুনির্দিষ্ট করা থাকাসহ অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে সে অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারণ করতে হবে।
বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ইস্কাটনে বিয়াম ফাউন্ডেশনে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আয়োজনে 'যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে প্রয়োজনীয়তা ও প্রত্যাশা' শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহিলা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (সমন্বয় ও সচেতনতা) নার্গিস সুলতানা জেবা, আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল, ব্র্যাকের স্যোশাল কম্পলায়েন্সের পরিচালক ব্যারিস্টার জেনেফা জব্বার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আসকের অগ্নি প্রকল্পের সমন্বয়কারী আসমা খানম রুবা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ২৯৪ ধারায় 'যৌন হয়রানি'র কথা উল্লেখ নেই এবং শান্তি কেবল তিন মাস। ৩৫৪ ধারায় নারীর 'শালীনতা' নষ্টের কথা উল্লেখ থাকলেও এই শব্দের কোনও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশে ৭৫ ও ৭৬ ধারায় যৌন হয়রানির কথা উল্লেখ থাকলেও শাস্তি যথাক্রমে তিন মাস ও এবং জরিমানা যথাক্রমে পাঁচশো ও দুই হাজার টাকা।
তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এ অভিযুক্তের শাস্তির পরিধি বৃদ্ধি পেলেও নারীর অঙ্গ স্পর্শ করার কথা বলা হয়েছে যা সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ শ্রম আইনে 'মহিলা' শব্দের ব্যবহার রয়েছে যা লিঙ্গনিরপেক্ষ নয়। এছাড়া ৭ অগাস্ট ২০০৮ সালের উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় শুধুমাত্র কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনের কথা বলা হয়েছে। রায়টির বাস্তবায়ন চেয়ে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি সকল কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠন না করায় ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর আইন সালিশ কেন্দ্র হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করে। ২০০৯ সালে প্রণীত হাইকোর্টের এই নীতিমালা কার্যকর হবে জাতীয় সংসদে যৌন হয়রানি রোধে আইন প্রণয়ন করার আগ পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত কোনও আইন প্রণীত হয়নি যার কারণে আইন ও সালিশ কেন্দ্র ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা প্রদানে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সভায় ব্র্যাকের স্যোশাল কম্পলায়েন্সের পরিচালক ব্যারিস্টার জেনেফা জব্বার বলেন, কমিটিতে যারা তদন্ত করে তাদের দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। দক্ষতা বলতে এখানে তাদের চিন্তা ও মানসিকতার কথা বলছি। নিউট্রাল হওয়া লাগবে। আজকে দেখা যাচ্ছে আমি ভুক্তভোগী, আমার হিজাব নেই সে যদি আমাকে আমার হিজাব না থাকা দিয়ে বিচার করেন তাহলে সুবিচার হবে না। এছাড়া আমাদেরকে এসব ক্ষেত্রে একটা কম্পলিট প্রসেস ফলো করতে হয়।
ইনকোয়ারি মানে হচ্ছে ডিসিপ্লিনারি রিয়েকশন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষার্থীর দ্বন্দ্ব হলে সেখানে আপনি কী করবেন— মধ্যস্ততা করবেন নাকি অন্যকিছু করবেন সিদ্ধান্ত আপনার নিতে হবে। যেমন প্রেম থাকতেই পারে কিন্তু কারও ইচ্ছে ছাড়া অন্যরকম কোনও আচরণ করা যাবে না। এই ইচ্ছার বিষয়— সেটা মাথায় রাখতে হবে। এই জিনিসগুলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কীভাবে দেখে সেটা একটা বড় বিষয়। পুলিশের কাছে আপনি হয়রানি নিয়ে গেলেন সে বলবে 'এটা কী নিয়ে আসছেন'। কারণ তাদের কাছে অনেক মামলা পড়ে থাকে। তাই এসব জায়গায় অভিযোগ কোথায় করবে সেক্ষেত্রে গ্যাপ আছে।
মহিলা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (সমন্বয় ও সচেতনতা) নার্গিস সুলতানা বলেন, আমাদের কমিটি আছে বিভিন্ন জায়গায় কিন্তু কাজ যদি ঠিকমতো না হয় তাহলে তো সমস্যা। উপজেলা পর্যায়ে যে কমিটিগুলো আছে সেখানে তেমন অভিযোগ পড়ে না। ওনারা যৌন হয়রানি বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে উঠান বৈঠক করেন। একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে আমরা আমাদের পরিবার থেকেই বেশি হয়রানির শিকার হই। পরিবারে ছেলে সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে— কোনটা অনুচিত। আমাদের বাইরে থেকেও বেশি ঘরে কাজ করতে হবে।
সভায় বক্তারা আরও বলেন, বিশেষ আইন বিশেষভাবে কাজ করে, কত দিনের মধ্যে বিচার কার্য সম্পন্ন হবে সেটা নির্দিষ্ট করাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিধানগুলো সুনির্দিষ্ট করা থাকলে ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে ত্বরান্বিত করবে। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কমিটি আছে তবে সেগুলো সক্রিয় না। চাকরি হারানোর ভয়ে সাহস করে কর্মীরা হয়রানির কথা সামনে বলেন না। তারা সামাজিক প্রতিকূলতা, চাকরি হারানোর শঙ্কা, চারিত্রিক অসম্মান হওয়ার ভয়সহ ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করতে মনোবল পান না। যথাযথ অভিযোগ করলে তদন্ত কমিটি গঠন হয় ঠিকই তবে কমিটির সদস্যরা তদন্তে যথাযথভাবে দক্ষ হন না। ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি যা চূড়ান্ত কিন্তু এর মাঝে আর কিছু নেই।