X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারীদের বাস সার্ভিস সম্পর্কে জানেন না অনেক নারী

আতিক হাসান শুভ
০৮ মার্চ ২০২৪, ১৫:০০আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪, ১৫:০০

নারীদের যাতায়ার নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে তাদের জন্য বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। সকালে ও বিকালে অফিস শুরু ও শেষে নারীদের জন্য এই সেবা চালু করা হয়। কিন্তু এসব বাস কোন রুটে, কখন চলে বা আদৌ চলাচল করে কিনা তার সঠিক তথ্য জানেন না রাজপথে চলাচলকারী বেশিরভাগ নারী।

১৯৯৮ সালে বিআরটিসির উদ্যোগে দেশে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক মহিলা বাস সার্ভিস চালু হয়। ২০০১ সালে তা ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়। ২০০৯ সালে আবার এই সেবাকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ২০১৫ সালেও এ সেবায় ১২টি বাস ছিল। বর্তমানে ৯টি রুটে ৯টি বাস চলছে বলে জানিয়েছেন বিআরটিসির কর্মকর্তারা। কোনও কোনও রুটে যাত্রীদের ভিড় থাকলেও বাসের পরিমাণ কম। এই বাস থেকে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বলেও জানান কর্মকর্তারা।

বিআরটিসির নারীদের জন্য বাস সার্ভিস কখন আসে, কখন যায় তার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই বেলে অভিযোগ যাত্রীদের। ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য মতে চলে না এ সার্ভিস। খোদ প্রধান কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যেই আছে গরমিল। কর্মকর্তারাই জানেন না এ বাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য।

যৌন হয়রানির ভয়কে সঙ্গী করেই গণপরিবহনে ওঠেন নারীরা (ছবি: প্রতীকী)

নারীদের জন্য কয়টি বাস চলাচল করে, এই বাস কখন ছাড়ে কখন ফিরে যায় এমন প্রশ্নের জবাবে বিআরটিসির ম্যানেজার মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, এই তথ্য আমার কাছে নেই। আমি সঠিক বলতে পারবো না। অপারেশনে যে আছে তিনি বলতে পারবেন।

বিআরটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) শুকদেব ঢালীর সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী, মোট ৯টি রুটে ৯টি বাস চলে ঢাকা শহরে। বনশ্রী থেকে মতিঝিল, মিরপুর থেকে কল্যাণপুর হয়ে মতিঝিল, মিরপুর ১২ থেকে ১০ নম্বর হয়ে মতিঝিল, মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল, নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিল, ডেমরা থেকে মতিঝিল, রূপনগর থেকে আগারগাঁও হয়ে মতিঝিল, তালতলা থেকে কলাবাগান হয়ে মতিঝিল এবং কল্যাণপুর থেকে মতিঝিল রুটে চলে এসব বাস।

প্রচার প্রচারণা জরুরি, বাস বাড়ানোর দাবি

ঢাকা শহরে যে নারী বাস সার্ভিস আছে, তা বেশিরভাগ নারীই জানেন না। কারণ এর কোনও প্রচার-প্রচারণা নেই। প্রচারের  বিষয়ে বিআরটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) শুকদেব ঢালী বলেন, প্রচারণার ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছি। তবে তা অপ্রতুল স্বীকার করে তিনি অন্য পন্থা অবলম্বন করার কথাও জানান। এক্ষেত্রে সড়কে বিলবোর্ড অথবা টেলিভিশনে প্রচারণার একটা বড় মাধ্যম হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

হাফসা হাফিজ নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, কর্মস্থল শেওড়াপাড়া। গত ছয় বছর ধরে তিনি নারীদের এই বাসে যাতায়াত করেন। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে বাসে উঠে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত যেতেই পুরো বাস ভর্তি হয়ে যায় যাত্রীতে। তিলধারণের ঠাঁই থাকে না। যাত্রীরা বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়েই যান। এই রুটে বাস বাড়ালে সুবিধাজনকভাবে চলাচল করা যেত।

নারীদের বাসে অনেক পুরুষও ওঠে অভিযোগ করে এই নারী কর্মজীবী বলেন, মাঝেমধ্যে এ বাস আর নারীদের বাস থাকে না, হয়ে যায় সবার বাস। তখন আসলে বোঝা যায় না নারীদের বাসে আছি নাকি পাবলিক বাসে আছি।

পস মেশিন থাকলেও নেই যাত্রী হিসাব

বিআরটিসির প্রতি বাসে ভাড়া আদায়ের টিকিট দেওয়ার জন্য আছে পয়েন্টস অব সেলস মেশিন (পস)। কিন্তু প্রতিদিন কি পরিমাণ যাত্রী হয় এবং ভাড়া আদায় হয়, তা জানার সুযোগ থাকলেও এ বিষয়ে কোনও বাস ডিপোর কেউ তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও এ তথ্য সংরক্ষণ নেই বলে জানান কর্মকর্তারা।

বিআরটিসির মতিঝিল ডিপোর এক কর্মকর্তা বলেন, বলতে গেলে এই খাতে রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত ভর্তুকি দিয়ে আসছে। মহিলা বাস সার্ভিসে নিয়োজিত বাস সেবা লসে চলছে।

জনবহুল ঢাকায় নারীবান্ধব এ পরিবহনসেবা লসে চলার কারণ কী এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, পস মেশিন থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই। অনেক হেলপার পস মেশিন ছাড়াই টাকা নেন। তাছাড়া বাসের চালক ও হেলপাররাই ঠিক করেন বাস কখন কীভাবে চলবে। সকালবেলা নারীদের পৌঁছে দিয়ে চালকরা অন্য ট্রিপ মারেন। চালকরা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ডিপোতে জমা দিয়ে বাকিটা চালক-হেলপাররা পকেটে ভরেন। রাষ্ট্রের লাভ না হলেও চালক-হেলপারদের ঠিকঠাক লাভ হয়।

বাসে নারীদের জন্য বরাদ্দ থাকা আসনগুলোতে অনেক সময় পুরুষদের বসার অভিযোগ পাওয়া যায় (নারীদের জন্য বরাদ্দ আসনের ফাইল ছবি)

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, নারীদের বিশেষ বাস সার্ভিস সারাদিন চালু রাখা উচিত। প্রতিটা রুটে ২০ মিনিট অন্তর বাস ছাড়লে লাভও হবে, যাত্রীও আসবে। বাসে শৃঙ্খলা নেই, নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই, সেই বাসে যাত্রী আসবে কোথা থেকে? প্রতিটা রুটে বাস দিলে রাজধানী নারীরা বিষয়টা জানতে পারবেন। তখন এই সেবাটা একটা স্ট্যান্ডার্ড সেবায় রূপান্তর হবে।

তবে চালকরা বলেছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, যাত্রী সংকট। ঠিকমতো যাত্রী পাওয়া যায় না। রাব্বি নামে এক বাসচালক বলেন, যাত্রী হোক আর না হোক প্রতিদিন দুই হাজার টাকার মতো জমা দিতে হয় ডিপোতে। মাঝেমধ্যে যাত্রীই থাকে না। এইজন্য নারীদের নামায়ে দিয়া আমরা আরও এক দুইটা খ্যাপ দেওয়ার চেষ্টা করি। নয়তো নিজের পকেটে থেকে টাকা দিতে হয়।

সার্ভিস বাড়ানোর দাবি

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম সদরঘাট। এই এলাকায় দেশের অন্যতম সেরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা মহানগর কলেজ, সেন্ট গ্রেগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট্রাল গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা গভমেন্ট মুসলিম হাইস্কুল সহ অসংখ্য নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত ছাড়াও নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত সহ বাণিজ্যিক কাজে প্রতিদিন এই এলাকায় লাখো মানুষের চলাচল।

সদরঘাট এলাকায় বিআরটিসির মহিলা বাস সার্ভিস চালুর দাবি জানিয়ে কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার বলেন, আমার বাসা উত্তর বাড্ডায়। আমার সপ্তাহে নূন্যতম চার থেকে পাঁচ দিন কলেজে আসতে হয়। আমার মতো আরও শত শত ছাত্রী আছে যারা নিয়মিত কলেজে যাতায়াত করে। বিআরটিসির নারী বাস সার্ভিস সম্পর্কে আমি পত্রপত্রিকায় জেনেছি। কিন্তু কখনও এর সুবিধা ভোগ করতে পারিনি। আমি বা আমার মতো নারী শিক্ষার্থীরা পাবলিক বাসে চলাচল করতে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের হয়রানির হতে হয়। নারীদের জন্য যে বাস সার্ভিস তা যদি সদরঘাট এলাকায় চালু হয় তাহলে আমার মতো অসংখ্য নারী পাবলিক বাসে যে হয়রানির শিকার হতে হয় তা থেকে রেহাই পাবো।

সুস্মিতা নামের একজন কর্মজীবী নারী বলেন, আমার কর্মস্থল রাজধানীর কলাবাগানে। আমি একটা বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করি। কাজের সুবাদে আমাকে সপ্তাহে অন্তত ছয়দিন সদরঘাট থেকে কলাবাগান যেতে হয়। এসময় গাদাগাদি করে পাবলিক বাসে চলাচলই একমাত্র উপায়। বাসে চলাচল করতে এমন অসংখ্য দিন আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছি। কিন্তু তবুও উপায় না দেখে আবার ঘুরে ফিরে সেই একি বাসে চলাচল করতে হয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় আমাদের জন্য সংরক্ষিত যে কয়টি আসন থাকে সেখানেও পুরুষেরা বসে থাকে। তখন কিছু করার থাকে না। সদরঘাট থেকে যদি নারীদের জন্য কোনও স্পেশাল বাস সার্ভিস চালু হয় তাহলে আমি বলবো এর চেয়ে ভালো উদ্যোগ আর হয় না।

সদরঘাটে বিআরটিসির মহিলা বাস সার্ভিস চালুর বিষয়ে বিআরটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) শুকদেব ঢালী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সদরঘাটের বিষয়টি যেহেতু বলেছেন আমরা বিষয়টি দেখবো। সদরঘাট এলাকায় নারীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু করার ব্যাপারে নারীরা যদি অফিসিয়ালি কোনও আবেদন করেন তাহলে আমরা নিশ্চয়ই ওই রুটে বাস দেবো। কল্যাণপুরে একজন নারী সাংবাদিক আবেদন করেছেন বাস দিতে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেই রুটে বাস দিয়েছি। ঢাকা শহরের যে কোন রুটে আমরা নারীদের চাহিদা অনুযায়ী বাস সার্ভিস চালু করতে প্রস্তুত আছি।

/এফএস/
সম্পর্কিত
বৃষ্টির প্রার্থনায় নামাজ
হিট অফিসারের পরামর্শে ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’ ছিটাবে ডিএনসিসি
বনানীতে যাত্রীবাহী বাসে আগুন
সর্বশেষ খবর
ফার্নিচার কারখানায় ৬০০ বস্তা চিনি মজুত
ফার্নিচার কারখানায় ৬০০ বস্তা চিনি মজুত
নির্বাচনে অংশ নিতে জাপার ওপর চাপ ছিল: জি এম কাদের
পরাজয় ঢাকতে অভিযোগ তুলছে বিএনপিনির্বাচনে অংশ নিতে জাপার ওপর চাপ ছিল: জি এম কাদের
কুড়িগ্রামে বিএনপির ৩ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার
কুড়িগ্রামে বিএনপির ৩ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার
বাগদাদে ইরাকি টিকটক তারকাকে গুলি করে হত্যা
বাগদাদে ইরাকি টিকটক তারকাকে গুলি করে হত্যা
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: এখনও অপেক্ষায় স্বজনরা
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: এখনও অপেক্ষায় স্বজনরা