X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মাদকাসক্তদের আলোর পথ দেখাচ্ছে ওয়েসিস

কবির হোসেন
১৬ মার্চ ২০২৪, ০৮:০০আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৪, ০৮:০০

মাদকাসক্তদের অন্ধকার জগত থেকে ফিরিয়ে আনাটা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবারকে। স্বজনরা খুঁজতে থাকেন কীভাবে তাকে মাদক থেকে নিরাময় করা যায়। দেশের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে এখনও যথাযথ সেবা ও নিরাপত্তা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সে কারণে অনেক পরিবারের অভিভাবকরা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে সম্মানহানির ভয়ে মাদক নিরাময় কেন্দ্র নিতে চান না তাদের সন্তানদের। আর এসব বিষয় মাথায় রেখে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আলোর পথে ফেরাতে কাজ করছে ‘ওয়েসিস’।

ওয়েসিস পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে পরিচালিত একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র ও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। সাধারণ মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে প্রায়শই রোগীকে নানাভাবে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু এটি একেবারেই আলাদা। কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে রোগীকে বুঝিয়ে তার চিকিৎসা করান তারা। এজন্য রয়েছে বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসক। যিনি ২৪ ঘণ্টাই এই প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেন। ফলে তার পরামর্শ ও সেবা পেয়ে রোগীরা দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠেন।

মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আলোর পথে ফেরাতে কাজ করছে ‘ওয়েসিস’ (ছবি: প্রতিবেদক)

সম্প্রতি সরেজমিনে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে অবস্থিত পুলিশের গড়া ওয়েসিস নামে ওই প্রতিষ্ঠানে গেলে দেখা যায়, এসব রোগীর জন্য সব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। একটি মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে যা কিছু প্রয়োজন সব ব্যবস্থাই রেখেছে সেখানে। রোগীদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নিজস্ব হোস্টেলে তৈরি খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে রোগীদের শারীরিকভাবে ফিট রাখতে জিমের ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও আছে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা। যেখানে রোগী ও তাদের স্বজনদের ইচ্ছে অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার নেওয়ার বিষয়টিও গোপন রাখতে পারেন। বিশেষ করে নারীদের জন্য আছে আলাদা ব্যবস্থা। নারীদের উপযোগী সবধরনের ব্যবস্থা রাখতে আলাদা ফ্লোর রাখা হয়েছে।

২০২১ সালের ৭ অক্টোবর এই ওয়েসিসের পথচলা শুরু হয়। মাত্র আড়াই বছরে প্রতিষ্ঠান থেকে আড়াইশো-এর বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। যারা সবাই ছিলেন মাদকাসক্ত, তারা এখন আলোর পথে।

শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম (ছদ্মনাম), বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একসময় মাদক নেওয়া শুরু করেন। প্রতিদিন বাবার দেওয়া হাত খরচ টাকা দিয়ে করতেন ইয়াবা সেবন। দুই বছর এক টানা এভাবে চলতে থাকে তার। নিজের এই অন্ধকার জগতের বিষয়টি একসময় তার বাব-মাকেও জানান। তারপরই পরিবার তাকে মাদক থেকে ফিরিয়ে আনতে নিয়ে আসে ওয়েসিস নামক এই মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। রবিউল সেখানে চার মাস থাকার পর বর্তমানে স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরেছেন। তাকে রিলিজ দেওয়ার দিন তার সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আমার জীবনকে শেষ করে দিয়েছিলাম। এতোদিন যদি এখানে না আসতাম হয়তো আরও খারাপের দিকে চলে যেতাম।’

ওয়েসিসে আছে খেলাধুলার ব্যবস্থা (ছবি: প্রতিবেদক)

তিনি জানান, ইয়াবা গ্রহণকালে নিয়মিত সেটি না নিলে তার পুরো শরীর ব্যথা করতো। রাতে ঘুম হতো না। খাবারের রুচি ছিল না। সব মিলিয়ে তখনকার জীবনটা ছিল অস্থির।

কীভাবে এই নেশায় আসক্ত হলেন জানতে চাইলে রবিউল বলেন, ‘আমার বাবা সরকারি চাকরি করেন। প্রতিদিন আমাকে হাত খরচের জন্য দুই থেকে তিনশ টাকা করে দিতেন। সেই টাকা না খেয়ে আমি ইয়াবা সেবন করতাম। বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই আমার জীবনটা বিপথে গিয়েছিল।

বিল্লাল হোসেন (ছদ্মনাম) পেশায় একজন ব্যবসায়ী। স্ত্রী- সন্তানদের নিয়ে তার সুখেই কাটছিল দিন। তিনিও বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। খাওয়া শুরু করে ফেনসিডিল। আসক্ত হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন রাতেই মাদক গ্রহণ করে বাসায় ফিরতেন। ঠিক তখনই সুখের সংসারে নেমে আসে অশান্তি। বিষয়টি বুঝতে পারে তার স্ত্রী তাকে সুস্থ জীবন স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে শুরু করে দৌড়ঝাঁপ। তারপরই তার স্ত্রী ওয়েসিস নামের একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে তাকে নিয়ে যান। সেখানে তাকে চার মাস রাখেন। বিষয়টি খুব গোপনেই করেন। স্বামী-স্ত্রী ছাড়া পরিবারের আর কেউই এ ব্যাপারটি জানতো না। বর্তমানে বিল্লালও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

বিল্লালের স্ত্রী তারিন (ছদ্মনাম) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার স্বামীর এ অবস্থা দেখে আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। দরজা বন্ধ করে একা একা কাদঁতাম। এসবের মাঝেই ওয়েসিস এর কথা জানতে পারি। নিয়ে এসে তাকে ভর্তি করাই। চার মাস রেখেছি, সে এখন সুস্থ। কিন্তু এই চার মাস আমার সন্তানরা জানতো না তাদের বাবা কোথায়। শুধু বলতাম, তোমার বাবা ঢাকার বাইরে একটা কাজে আছে। আমি শুধু প্রতি মাসে এসে দেখা করে যেতাম। চার মাসে বেশি টাকাও খরচ হয়নি। সবকিছুই ছিল সাধ্যের মধ্যে। এই ওয়েসিসই আমার স্বামীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছে। নাহলে এতদিন আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে যেতো।’

আছে শরীরচর্চার ব্যবস্থাও (ছবি: প্রতিবেদক)

শুধু রবিউল আর বিল্লাল না তাদের মতো অনেক মাদকাসক্তরাই এখানে চিকিৎসা নিয়ে ফিরছেন সুস্থ জীবনে। ওয়েসিসের সাইকিয়াট্রিক ও চিকিৎসক মোর্তজা হাসান বলেন, ‘এখানে সব ধরনের মাদকাসক্তরাই আসে। আমরা আগে জেনে নেই তিনি কী ধরনের মাদক গ্রহণ করেন। সেটার ওপর নির্ভর করে তার চিকিৎসাটা শুরু করতে করি। মাদক গ্রহণের ওপর একজন রোগীর চিকিৎসা ও মেডিসিন নির্ভর করে। তার পাশাপাশি যদি অন্য কোনও সমস্যা থাকে, যেমন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা; সেটার ওপর নির্ভর করেও আমাদের ওষুধ প্রয়োগ করি। এই ডিটক্সিফিকেশন সময়কালটা কারও এক মাস আবার কারও দুই মাস লাগে। অনেকের আবার কম সময় লাগে, কারও বেশি সময়ও লাগে। একজন রোগীকে শুধু আমরা সুস্থ করি না, পরবর্তী সময়েও তার ফলোআপ রাখা হয়। চিকিৎসা নিয়ে চলে যাওয়ার পরও তিনি যেন ফলোআপে আসেন, সেজন্য আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি।’

প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক সুশান্ত নারায়ণ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে থেকে একজন রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরার পর পরবর্তীতে ওই রোগীর যে সাইকিয়াটিক চিকিৎসার কাউন্সিলিং প্রয়োজন হয় আর সেটি যতদিন দরকার তা আমরা ফ্রিতে দিয়ে থাকি অর্থাৎ বিনামূল্যে করা হয়। একজন রোগীকে স্থায়ীকে ভাল করতে যা যা উদ্যোগ নেওয়া দরকার হয় আমরা তার সবটাই করি। এছাড়াও আমরা ২৪ ঘণ্টার টেলি মেডিসিন (ফ্রি) সেবা দিয়ে থাকি। যার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সর্বদা নিয়োজিত থাকেন। এজন্য যে কেউ পরামর্শ বা সেবার জন্য ০১৯৩০-৪০৪০৪০ নম্বরে কল করতে পারেন। যেসব অভিভাবক সন্তানদের মাদকাসক্তির বিষয়টি ধরতে পারেন না, এ বিষয়ে কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন না, তারাও এই নম্বরে কল করলে পরামর্শ নিতে পারেন।’

দেওয়া হয় মানসিক রোগের চিকিৎসাও (ছবি: প্রতিবেদক)

এ প্রসঙ্গে ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা মাদকাসক্ত কিংবা মাদকের ব্যবসা করেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনে সুযোগ রয়েছে। তার পাশাপাশি পুলিশের একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়ও রয়েছে। সেই সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা চিন্তা করেই ওয়েসিস গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই সমাজের উচ্চবিত্ত ও ধনাঢ্য পরিবারের। তবে তাদের পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়। কে কোন পরিবার থেকে এসেছে, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত নাকি অন্য কোথাও থেকে এসেছেন; সেসব বিষয় আমলে নেওয়া হয় না। চিকিৎসক তার চিকিৎসা সেবা অনুযায়ী সবাইকেই চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।’

তিনি বলেন, ‘মাদকাসক্ত কিংবা মানসিক যে সমস্যার কারণেই হোক— যারা এই ওয়েসিসে এসে ভর্তি হন, প্রথমেই তাদের সমস্যার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়। আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন, মানসিক চিকিৎসক রয়েছেন। মাদকাসক্ত এবং মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং সবচেয়ে বড় বিষয়। কাউন্সিলিংয়ের জন্যও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। শুধু মাদকাসক্ত ব্যক্তি নয়, গ্রুপ কাউন্সেলিং এমনকি মাদকাসক্ত পরিবারের সদস্যদেরও কাউন্সেলিং করা হয়ে থাকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে।’

/ইউএস/
সম্পর্কিত
ইট-পাথরের নগরীতে একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
সর্বশেষ খবর
ময়মনসিংহে বাস-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ, দম্পতি নিহত
ময়মনসিংহে বাস-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ, দম্পতি নিহত
নিউইয়র্কে সাকিবের ব্যবহারে মুগ্ধ বাংলাদেশের সাবেক গোলকিপার 
নিউইয়র্কে সাকিবের ব্যবহারে মুগ্ধ বাংলাদেশের সাবেক গোলকিপার 
ইট-পাথরের নগরীতে একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে
ইট-পাথরের নগরীতে একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে
তাইওয়ানের কাছাকাছি আবারও সামরিক কার্যকলাপ চালালো চীন
তাইওয়ানের কাছাকাছি আবারও সামরিক কার্যকলাপ চালালো চীন
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!