X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাকাত: সমৃদ্ধ জাতি গঠনের উন্নত পথ

এনামুল করীম ইমাম
২৫ মার্চ ২০২৪, ১১:১২আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৪, ১১:১২

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবকল্যাণই ইসলামের মূলমন্ত্র। তাই ইসলাম তার যাবতীয় কর্মই মানবকল্যাণের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। জাকাত তার জ্বলন্ত উদাহরণ। জাকাতের মাধ্যমে গরিবের প্রতি ধনীদের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে। সমাজে সাম্য, সম্প্রীতি এবং মানবতা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নামাজ-রোজার মতই জাকাত ইসলামের অন্যতম একটি ফরজ ইবাদত। জাকাত হলো আর্থিক ইবাদত। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষদের ওপর জাকাত আদায় বাধ্যতামূলক। আর্থিক সচ্ছলতার কোন পর্যায়ে জাকাত আদায় করতে হবে সেটি ইসলাম স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে। কী পরিমাণ জাকাত একজন মানুষকে আদায় করতে হবে, সেটিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। জাকাতের পরিমাণ হিসাবের ফর্মুলা এবং জাকাতের অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় করতে হবে সেটিও নির্ধারণ করা আছে।

জাকাত একটি আরবি পরিভাষা। এর অর্থ পবিত্রতা, প্রাচুর্য, ক্রমবৃদ্ধি এবং প্রশংসা ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায়, জাকাত হলো সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ যা নিঃস্বার্থভাবে কোনও অসহায় মুসলমানকে দান করা হয়। জাকাত হচ্ছে অসহায়, অভাবী, অক্ষম এবং সুবিধাবঞ্চিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্যবিমোচনের মূল হাতিয়ার। জাকাত হলো একটি মানবিক সমাজ গড়ে তোলার হাতিয়ার। মানবকল্যাণই জাকাতের মূলমন্ত্র।

জাকাত আদায়ের মাধ্যমে একজন মানুষের সম্পদ পবিত্রতা অর্জন করে, আর সেই জাকাতের অর্থ দিয়ে বঞ্চিত মানুষের সমস্যার সমাধান হয়। জাকাত হলো ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার, যা আদায় করতে ধনী ব্যক্তিটি বাধ্য। মহান আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে সালাত আদায়ের পরে সবচেয়ে বেশি জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআনে মোট ৩২ বার জাকাত আদায়ের নির্দেশ রয়েছে। এককভাবে সাতবার আর সালাতের সাথে ২৫ বার জাকাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে।

ঈমান ও নামাজের পরে জাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। জাকাত প্রদান মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন–

(ওইসব মুমিনরাই সফল হয়েছে) যারা যাকাত আদায় করে থাকে। [সুরা মুমিনুন, আয়াত : ০৪]

পক্ষান্তরে জাকাত আদায় না করা কাফেরদের বৈশিষ্ট্য এবং জাহান্নামের শাস্তির অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন:

ধ্বংস মুশরিকদের জন্য, যারা জাকাত প্রদান করে না, আর যারা আখেরাতে অবিশ্বাস করে। [সুরা হা-মিম সাজদাহ, আয়াত : ৬-৭]

পবিত্র কোরআনুল কারিমের অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, জাহান্নামিদের যখন শাস্তি ভোগের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে তখন তারা বলবে :

আমরা নামাজ আদায়কারীগণের মধ্যে ছিলাম না। আর আমরা দরিদ্রদেরকে খাওয়াতাম না। [সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত : ৪২-৪৩]

লক্ষণীয় বিষয় হলো, জাকাত প্রদানের কারণে যদিও বাহ্যিকভাবে দেখা যায় যে, সম্পদ কমে যাচ্ছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জাকাতের দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তাআলা বলেন :

আল্লাহ তাআলা সুদের বৃদ্ধিকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করেন আর ‘সদকা’ বা জাকাতকে বৃদ্ধি করেন। [সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৬]

অপর স্থানে আল্লাহ তাআলার ইরশাদ করেন :

তোমরা মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য যে বৃদ্ধি (সুদ) প্রদান করো তা আল্লাহ তাআলার নিকট বৃদ্ধি পায় না। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তোমরা যে জাকাত প্রদান করো সেই জাকাতই হলো বহুগুণ বৃদ্ধিকারী। [সুরা রুম, আয়াত : ৩৯]

জাকাত আদায়ের প্রতি সীমাহীন গুরুত্বারোপ করেছেন আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। হাদিসে নববিতে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মুআবিয়া রাদি. বর্ণিত, নবীজি বলেন:

যে তিনটি কাজ করবে সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করবে : এক. যে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে। দুই. জানবে যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনও মাবুদ নেই এবং তিন. আনন্দিত চিত্তে পবিত্র মনে তার সম্পদের জাকাত প্রদান করবে। [আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৮২]

জাকাত প্রদানের দ্বারা কেবল আখেরাতের লাভই না, দুনিয়ার অনেক উপকারও হয়। কারণ, এ দ্বারা সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

যে তার সম্পদের জাকাত প্রদান করে, তার সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয়ে যায়। [মাজমাউয-যাওয়াইদ, হাদিস : ৪৩৩৪]

লক্ষণীয় বিষয় হলো, জাকাত আদায়ের কল্যাণও যেমন ব্যাপক, আবার আদায় না করার ক্ষতিও তেমন মারাত্মক। অত্যন্ত কঠিন, ভীষণ ভয়াবহ। এমনকি, প্রথমে যে তিন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে তাদের একজন হলো জাকাত প্রদান থেকে বিরত সম্পদশালী মুসলিম। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

প্রথমে যে তিন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে তারা হলো : স্বেচ্ছাচারী শাসক বা প্রশাসক, সম্পদশালী ব্যক্তি যে তার সম্পদে আল্লাহর যে অধিকার (জাকাত) প্রদান করে না এবং পাপাচারে লিপ্ত দরিদ্র ব্যক্তি। [সহিহ হিব্বান, আয়াত : ৭৪৮১; আবু দাউদ, হাদিস : ২৬৯০; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৯৪৯২]

যেই মুসলিম জাকাত আদায় থেকে বিরত থাকে, অথবা জাকাত দিতে টালবাহনা বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে হাদিসে নববিতে তাকে অভিশপ্ত বা মালউন বলা হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন :

জাকাত প্রদানে যে ব্যক্তি টালবাহনা করে বা বিরত থাকে, সে কিয়ামতের দিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জবানীতে অভিশপ্ত হবে। [আবু দাউদ, হাদিস : ৪০১; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৪৭]

আর যারা জাকাত আদায় না করে সম্পদ জমিয়ে রাখে তাদের বিষয়ে পবিত্র কোরআনুল কারিমে কঠিন হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :

আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে যে সম্পদ দান করেছেন সেই সম্পদ নিয়ে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কখনই মনে না করে যে, তাদের এই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণবহ বা উপকারী, বরং তা তাদের জন্য ক্ষতিকর। তাদের কৃপণতা করে সঞ্চিত সম্পদ কিয়ামতের দিন তাদের গলার বেড়ি হবে। [সুরা আল-ইমরান, আয়াত : ১৮০]

কিছু পাপ এত কঠিন যে, এগুলোর শাস্তি শুধু আখেরাতেই নয়, দুনিয়াতেও ভোগ করতে হয়। বিশেষ করে যে পাপ মানুষের অধিকারের সাথে জড়িত এবং যে পাপের ফলে অন্য মানুষ কষ্ট পায় বা সমাজের ক্ষতি হয়। এমন পাপ যদি সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আল্লাহ তাআলা ওই সমাজে গজব নাজিল করেন এবং সমাজের সকলেই সে শাস্তি ভোগ করে। জাকাত প্রদানে টালবাহানা সেসব পাপের অন্যতম। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক দীর্ঘ হাদিসে এরশাদ হয়েছে :

যদি কোনও সম্প্রদায়ের মানুষ জাকাত প্রদান না করে, তাহলে তারা অনাবৃষ্টির শিকার হয়। যদি পশুপাখি না থাকতো তাহলে তারা বৃষ্টি থেকে একেবারেই বঞ্চিত হতো। [ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯]

আসুন সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্ধারিত হারে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করি। সেই সাথে সমাজ থেকে দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ভূমিকা রাখি।

উল্লেখ্য, জাকাতের অর্থ সারা বছর ধরেই বিতরণ করা যেতে পারে। তবে পবিত্র রমজান মাস তথা ঈদুল ফিতরের আগেই বছরের সব জাকাত পরিশোধ করা উচিত। তাহলে বছরের হিসাব রাখতেও সুবিধা হবে। সাথে সাথে রমজান মাসে দান করার অতিরিক্ত সাওয়াবও পাওয়া যাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে জাকাত আদায় করে দোজাহানের অশেষ কামিয়াবি হাসিল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক: মুহাদ্দিস, মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর-১২, পল্লবী, ঢাকা।

/এসটিএস/এমএস/
সম্পর্কিত
ফিতরা-জাকাতের নামেও প্রতারণা
ঈদুল ফিতরে করণীয়
চাঁদ দেখা যায়নি, ঈদ বৃহস্পতিবার
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ