X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানের শেষ দশ দিনে ইতেকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত 

মুফতি আবু মুআজ
৩০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৬আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৬

রমজান মাসের প্রতিটি ক্ষণই মুসলিম উম্মাহর জন্য মহামূল্যবান। পরকালীন চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য মুমিনরা এই মাসে বেশি বেশি আমল করেন। প্রথম দশ দিনে আল্লাহর রহমতে বান্দা নিজেকে পবিত্রতায় সিক্ত করে নেয়, দ্বিতীয় দশ দিনে ক্ষমা লাভের মাধ্যমে বান্দা নিজেকে আল্লাহর কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়। আর শেষ দশ দিনে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার নিশ্চয়তা লাভের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে। এ জন্য মহান আল্লাহ ও তার রাসুল রমজানের শেষ দশকের প্রতি অসাধারণ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং নানা নফল ইবাদতের দ্বারা শেষ দশককে সমৃদ্ধ করেছেন। 

রমজানের শেষ দশ দিনের মর্যাদা

রমজান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো শেষ দশ দিন। কারণ, আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এই সময়কে অনেক গুরুত্ব দিতেন। এই সময়ে তাঁর আমল বর্ণনা করতে গিয়ে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘প্রিয় নবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে (ইবাদত-বন্দেগিতে) যে পরিশ্রম করতেন, তা অন্য কোনও সময় করতেন না।’ [সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৭৫; তিরমিজি, হাদিস : ৭৯৬]

প্রিয় নবীর (সা.) পরিবারের সদস্য ও প্রিয় জামাতা আলি ইবনে আবি তালিব (রা) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশকে প্রিয় নবী (সা) (ইবাদত-বন্দেগি করার নিমিত্ত) তার পরিবারদের (রাতে) জাগিয়ে দিতেন। [তিরমিজি, হাদিস : ৭৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৭৬২]

আয়েশা (রা.) আরও বলেন, ‘প্রিয় নবী (সা) যখন রমজানের শেষ দশকে প্রবেশ করতেন, তখন রাতে জেগে থাকতেন, পোশাক-পরিধেয় বেঁধে নিতেন এবং পরিবারের সদস্যদের (ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য) জাগিয়ে রাখতেন। [সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০২৪; মুসলিম, হাদিস: ১১৭৪]

আমাদেরও রমজানের শেষ দশকে ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া চাই। বিশেষ করে বিজোড় রাতগুলোতে। কারণ, এ রাতগুলোতেই আছে কুরআন নাজিলের মতো মহা-অর্জনসমৃদ্ধ হাজার বছরের চেয়ে সেরা রজনি লাইলাতুল কদর। যেটি রমজানের শেষ দশকের অন্যতম ইবাদত হলো ইতেকাফ।

ইতেকাফের পরিচয় 

ইতেকাফের শব্দের অর্থ স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা, অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায়, মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন বা যেকোনও দিন দুনিয়াবি সব কাজকর্ম তথা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে বা ঘরের পবিত্র স্থানে ইবাদতের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘মসজিদে ইতেকাফ করা অবস্থায় তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত হবে না।’ [সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৭]

পুরুষরা কেবল শুধু মসজিদেই ইতেকাফ করতে পারবে। সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদে হারাম, অতঃপর মসজিদে নববি। এরপর মসজিদে আকসা। অতঃপর যেকোনো জামে মসজিদ। যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়, সে মসজিদে ইতেকাফ করা যায়। তবে জামে মসজিদ উত্তম। কারণ, তখন জুমা নামাজের জন্য অন্যত্র যেতে হবে না। [ফাতওয়ায়ে শামি : ২/১২৯]

মহিলাদের জন্য ইতেকাফ করা মুস্তাহাব। তাদের ইতেকাফের স্থান হলো, গৃহকোণের নামাজের স্থান। স্ত্রীর ইতেকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি জরুরি।
ইতেকাফ অবস্থায় ওজু, এস্তেঞ্জা, পানাহার ইত্যাদি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। অবশ্য মসজিদে অবস্থানকালে ঘুম, বসে থাকা বা কথাবার্তা বলা যায়। তবে ইতেকাফ অবস্থায় যথাসম্ভব সকল প্রকার জাগতিক চিন্তা-ভাবনা, কথাবার্তা ও মেলামেশা বাদ দিয়ে সাধ্যমতো আল্লাহর জিকির ও ইবাদত বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকার চেষ্টা করতে হবে। না হলে অন্তত নীরব থাকার চেষ্টা করতে হবে।

ইতেকাফ তিন প্রকার

১. সুন্নত ইতেকাফ: রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফকে সুন্নত ইতেকাফ বলে। ২১ তারিখ রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ইতেকাফের সময়। অবশ্য এই ইতেকাফ ভেঙে গেলে, পরে এর কাজা করা ওয়াজিব।

২. ওয়াজিব ইতেকাফ: মানতের ইতেকাফ বা সুন্নত ইতেকাফের কাজা ইতেকাফ ওয়াজিব। 

৩. নফল ইতেকাফ: এই ইতেকাফ যেকোনও সময় করা যায়। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। যেকোনও ওয়াক্তে মসজিদে প্রবেশ করার সময় নফল ইতেকাফের নিয়ত করা সুন্নত। 

ইতেকাফের শর্ত

১. নিয়ত করা ২. জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে ইতেকাফ করা। ৩. ইতেকাফকারীর রোজাদার হওয়া। ৪. জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম স্ত্রী-পুরুষের জানাবাত ও মহিলারা হায়েজ-নেফাস হতে পাক হওয়া ৬. পুরুষ লোকের জামে মসজিদে ইতেকাফ করা ৭. সর্বদা হদসে আকবার থেকে পাক-পবিত্র থাকা।

ইতেকাফের উদ্দেশ্য

দুনিয়াদারির ঝামেলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়া এবং বিনয় ও নম্রতায় নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা, বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করার সুযোগ লাভ করাই ইতেকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ইতেকাফের গুরুত্ব

ইতেকাফ এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত উমর (রা.) জাহেলি যুগের মানতকৃত ইতেকাফ ইসলাম গ্রহণের পর পূরণ করতে বলেছিলেন। নবিজির নিজেও ইতেকাফের আমল করতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশার (রা.) বর্ণনায় এসেছে, ‘প্রিয় নবী (সা.) ইন্তেকাল পর্যন্ত প্রতিবছরই রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সহধর্মিণীরাও ইতেকাফ পালন করতেন। [সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৬; মুসলিম, হাদিস : ১১৭২]

ইতেকাফের ফজিলত 

ইতেকাফের বিরাট ফজিলতের কথা ঘোষিত হয়েছে হাদিসে নববিতে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘যদি কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে রওয়ানা হয়, তাহলে এটা তার জন্য দশ বছর ইতেকাফ করার চেয়েও উত্তম। আর যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইতেকাফ করবে আল্লাহ তার ও জাহান্নামের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। [শুআবুল ইমান লিল-বায়হাকি, হাদিস : ৩৬৭৯]

ইতেকাফের বিশেষ লাভ

ইতেকাফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মোটকথা, পবিত্র রমাযান মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি বড় মাধ্যম হলো ইতেকাফ। এর পাশাপাশি লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভের জন্যও এ সময়ে ইতেকাফের গুরুত্ব অনেক বেশি। অর্থাৎ লাইলাতুল কদরপ্রাপ্তি, গুনাহ থেকে পরিত্রাণ, বাকি ১১ মাসের ইবাদতের যথার্থ অনুশীলনসহ অসংখ্য বরকতপূর্ণ আমল করা হয় রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফের মাধ্যমে। 

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘আমি লাইলাতুল কদরের মহিমা অনুসন্ধানে প্রথম দশদিন ইতেকাফ করেছি। অতঃপর এবং মাঝের দশদিন ইতেকাফ করেছি, অবশেষে আমার কাছে একজন ফেরেশতা এসে বলেন, তা শেষ দশকে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যারা ইতেকাফ করতে চায়, তারা যেন শেষ দশকে ইতেকাফ করে। অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সঙ্গে শেষ দশকে ইতেকাফ করলেন। [সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬৭]

উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, একমাত্র ইতেকাফের মাধ্যমেই পবিত্র রমজানের শেষ দশ দিনের পূর্ণ সাওয়াব ও সৌভাগ্য লাভ করে ধন্য হওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে ইতেকাফ করে বরকত ও কল্যাণ লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন। 

লেখক: ভাইস প্রিন্সিপাল, হেরার পথে মাদ্রাসা কমপ্লেক্স, জয়রা, সদর, মানিকগঞ্জ

/ইউএস/
সম্পর্কিত
ঈদুল ফিতরে করণীয়
চাঁদ দেখা যায়নি, ঈদ বৃহস্পতিবার
আবেগে নয়, জাকাত আদায় করতে হবে মাসআলা জেনে
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ