X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

উপবৃত্তির নামে প্রতারণা, ক্রেডিট-ডেবিট কার্ডে অর্থ লুট

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
২২ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:১০আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:১০

শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নামে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসছিল একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ চক্রের লাগাম টানতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ছয়টি দল যৌথ অভিযান চালায়। এ সময় চক্রের মূলহোতাসহ ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

রবিবার (২১) এপ্রিল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতের ঢাকা, গাজীপুর, নারায়গঞ্জ, জামালপুর, কুমিল্লা ও ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪, ৫, ৮, ১০, ১১ ও ১৪ ব্যাটালিয়ন আভিযানিক দল।

র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী গ্রেফতারকৃতরা হলেন—চক্রের মূলহোতা জাকির হোসেন হাওলাদার (৪৭) ও অন্যতম মূল সহযোগী মো. বাপ্পি মোল্লা (২০), মো. উসমান গনি মোল্লা (৩৩), শামীম হোসেন (২৯), মোহাম্মদ জিহাদ (৩৪), কাজী সাদ্দাম হোসেন ওরফে আমির হামজা (২৬), মো. আহাদ গাজী (২৪), মো. মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে জয়(২৬)।

এ চক্রের সঙ্গে একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও রয়েছে। তারা অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহার করে।

র‌্যাব বলছে, সারা দেশে এই চক্রের ২ হাজারের বেশি সক্রিয় এজেন্ট রয়েছে। এক রকম শেয়ার বাজারের মতো দরকষাকষি করে তাদের হাজারে ৩০/৪০ টাকা কমিশনে প্রতারণার কাজ দেওয়া হয়। চক্রের এজেন্ট হতে হলে তাদের অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস

সোমবার (২২ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাব-৫ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস।

তিনি বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে একটি প্রতারক চক্র বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে আসছিল।

তিনি বলেন, গত ২৪ মার্চ রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানাধীন শালবাগান রাজশাহীর বিএনসিসি অফিসে অবস্থানকালে এক ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে অজ্ঞাতনামা মোবাইল নম্বর থেকে কল আসে। মেয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টেট শাখায় কর্মরত মিজানুর রহমান বলে পরিচয় দেয় এক ব্যক্তি। তার মেয়ের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ায় শিক্ষা উপবৃত্তির ২২ হাজার ৫০০ টাকা এসেছে বলে জানায় সে।

ওই টাকা বাদীর অ্যাকাউন্টে চলে যাবে উল্লেখ করে একটি ব্যাংকের এটিএম কার্ডের ষোল ডিজিটের নম্বর দিতে বললে তিনি সেটা দেন। এরপর ওটিপিও ওদের জানান। পরে বাদী মোবাইল মেসেজ অপশনে দেখতে পান তার অ্যাকাউন্ট থেকে চার বারে ১ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।  

র‌্যাবের জব্দ করা সরঞ্জাম

এই ঘটনায় তিনি অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে আরএমপির বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে রাজশাহীর র‌্যাব-৫ জড়িতদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। পরে র‌্যাব-৫ এর একটি দল প্রতারণার কাজে জড়িত শামীম হোসেনকে রাজশাহী জেলার রাজপাড়া থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে।

শামীম জানায়, সে শুধু মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা দিত। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানা এলাকায় একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির সিম কার্ডসহ বেশ কয়েকটি মোবাইল উদ্ধার করে। এরপর একে একে চক্রের মূলহোতা জাকিরসহ অন্যদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ২৩টি মোবাইল সেট, ৩১০টি সিম কার্ড, নগদ-৩ লাখ ১২৭০ টাকা ও ৯টি ব্যাংক লেনদেন স্লিপ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত প্রত্যেকটি সিম কার্ডে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট রয়েছে।

‘ওয়েলকাম’ ও ‘হ্যালো’ গ্রুপ

তারা এলাকায় পরিচিতি ‘ওয়েলকাম’ ও ‘হ্যালো’ গ্রুপের সদস্য হিসেবে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সরকারি অফিস থেকে শিক্ষা উপবৃত্তি টাকা দেওয়ার তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর তারা ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের কল সেন্টারে শেয়ার করে। এরপর মূলহোতা জাকির হোসেনের দুই ছেলে মানিক ও হিরা ফোন দেয়। নম্বর নেয়। কথা বলে বিশ্বস্ততা অর্জন করে ওটিপি নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে।

সারা দেশে এজেন্ট ২ হাজার

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-৫ অধিনায়ক বলেন, ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের রয়েছে সারা দেশে ২ হাজারের বেশি এজেন্ট। এজেন্ট হতে হলে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে এন্ট্রি করতে হয়। এরপর মোবাইলে তাদের নামে একটা অ্যাকাউন্ট হয়। ইতোমধ্যে তদন্তে ১৮৬ টি মোবাইল নম্বর শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলোয় টাকা লেনদেন ও যোগাযোগ হয়েছে।

হাজারে এজেন্ট কমিশন ৩০/৪০ টাকা

হাজারে ৩০ বা ৪০ টাকা কমিশন পাবার চুক্তিতে প্রতারণার কাজে এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। এজেন্টের এন্ট্রিকৃত মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা যায়। তবে ক্রেডিট কার্ড থাকে মূল চক্রের হাতে। টাকা ঢোকা মাত্র তারা তুলে নেয়।

শহর থেকে দূরে অবস্থান করে চক্রের সদস্যরা

এই চক্রের সদস্যরা এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না। মূল শহর থেকে ১৫/১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে। টাকা আসা মাত্র কাছের কোনও এজেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে টাকা উঠিয়ে নেয়। তারা নিজেরা অন্য কোনও যানবাহনে চলাচল না করে মোটরসাইকেলে চলাচল করে। বাড়িতেও থাকে না, নির্জনে থাকে।

বংশ পরম্পরায় প্রতারণা 

এই প্রতারণাকে তারা ব্যবসা হিসেবে দেখে, খারাপ কিছু ভাবেন না। তারা শুধু নিজেরা নয়, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এ কাজে জড়িত। প্রতারক চক্রের সদস্যদের বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনরাও প্রভাবিত হয়ে অনেকে এই অভিনব প্রতারণার কাজে জড়িয়ে পড়েছে র‌্যাব তথ্য পেয়েছে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনির বলেন, খোকন মোল্লা এই প্রতারণায় জড়িত। অভিযানের সংবাদে পলাতক খোকন মোল্লার ছেলে বাপ্পি মোল্লাকে আমরা গ্রেফতার করেছি। আমরা জানতে পেরেছি খোকন মোল্লার মোবাইলে একদিনে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা এসেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

অন্যদিকে মূলহোতা জাকির হোসেন হাওলাদারকে গ্রেফতারের পর তার মোবাইলে দেখা গেছে, দুই লক্ষাধিক টাকা আদান-প্রদান হয়েছে।

দর কষাকষিতে ভাগ হয় প্রতারণার কাজ

চক্রের যারা সদস্য রয়েছে তাদের মধ্যে দর কষাকষি হয়। এক রকম শেয়ারবাজারের লেনদেনের মতো দর ওঠানামা করে। কেউ হাজার টাকায় ৪০ টাকা, কেউ হাজার টাকায় ৩০ টাকা কমিশন পেতে কাজটি নেয়৷ তাদের মধ্যে যারা পারদর্শী ও বিশ্বস্ত তাদের কাজটি দেওয়া হয়। অর্থ আত্মসাতের কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর সেই এজেন্ট নিজের প্রাপ্ত অংশ রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেয়। এরপর প্রচার চক্রের মূলহোতা বাকি টাকা বন্টন করে দেয়।

প্রতারণায় ব্যবহার অন্যের সিম

চক্রটির সঙ্গে জড়িত একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও। তারা অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম বা বিক্রি করা সিম সংগ্রহ করে প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহার করে এবং মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলে।

একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম বিক্রেতা গ্রেফতার আহাদ গাজী। কোম্পানি থেকে টার্গেট রয়েছে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ সিম বিক্রি করতে হবে। বিক্রি করতে না পারলে তাকে চাপে থাকতে হয়। এজন্য বিভিন্ন লোক আসলেই তারা ৫০ বা ১০০ টাকায় সিম বিক্রি করে। যদিও এই সিম ফ্রিতে দেওয়ার কথা। সাধারণ মানুষের সংগৃহীত এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে সিম বিক্রি করে। কেউ ফেরত দিলে সেটি সংগ্রহ করে প্রতারণার কাজে লাগায় এই চক্র। ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় এসব সিম সংগ্রহ করে তারা।

/এবি/এফএস/
সম্পর্কিত
শর্টকাটে বড়লোক হতে গিয়ে
কষ্টিপাথর কিনে প্রতারিত হয়ে অপহরণ, গ্রেফতার ৭
পিকআপ চাপায় র‌্যাব সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় চালক গ্রেফতার
সর্বশেষ খবর
নবযুগ প্রকাশনীর কর্ণধার অশোক রায় নন্দী মারা গেছেন
নবযুগ প্রকাশনীর কর্ণধার অশোক রায় নন্দী মারা গেছেন
মালয়েশিয়ায় আটকে পড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ
মালয়েশিয়ায় আটকে পড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে মুক্তিযোদ্ধাকে গাছে বেঁধে বিচারের হুমকি
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে মুক্তিযোদ্ধাকে গাছে বেঁধে বিচারের হুমকি
রোগীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসে সড়কে প্রাণ গেলো ৩ জনের
রোগীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসে সড়কে প্রাণ গেলো ৩ জনের
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
গাজীপুরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, বগি লাইনচ্যুত
গাজীপুরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, বগি লাইনচ্যুত