মাদক মামলায় সাজার হার না বাড়ার ১০টি কারণ খুঁজে বের করেছে পুলিশ। এই দশ কারণ ও করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করে তা যথাযথভাব অনুসরণ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও তদন্ত তদারকি কর্মকর্তাদের এই নির্দেশনা মেনে মামলা তদন্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতর ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দফতরে একাধিক মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় মাদক মামলায় সাজার হার না বাড়ার কারণ নিয়ে আলোচনা হয়। গত বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাদক মামলার সাজার হার ছিল ৩৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মাদক উদ্ধারজনিত মামলার বাদী হন পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশ বাদী এবং পুলিশি তদন্তের পরও মাদক মামলার আসামিদের খালাস পেয়ে যাওয়া দুঃখজনক। এছাড়া মাদক মামলায় শুধু বহনকারীদের গ্রেফতার না করে মামলার তদন্তে মাদকের উৎস পর্যন্ত যাওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আজহার ইসলাম মুকুল জানান, মাদক মামলায় সব সময় উৎসমূলে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া মাদক মামলায় সাজার হার বাড়ার জন্য তদন্তের গুণগত মানও উন্নত করা হচ্ছে।
সাজার হার না বাড়ার ১০ কারণ
ডিএমপি সূত্র জানায়, বিভিন্ন মাদক মামলা, মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে ১০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- এজাহার দায়ের ও জব্দ তালিকা প্রস্তুতের সময় গড়মিল। এজাহার দায়েরকারী ও তদন্তকারী পুলিশ অফিসার একই ব্যক্তি হওয়া। জব্দ তালিকায় জব্দকৃত আলামতের সঠিক পরিমাণ, রঙ, আলামতের অবস্থা ইত্যাদি সঠিকভাবে উল্লেখ না করা, উদ্ধার মালামালের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় জব্দ তালিকায় ভাসমান বা অস্থায়ী ঠিকানার ব্যক্তিদের সাক্ষী মানা, জব্দ তালিকার সাক্ষীদের সঠিকভাবে ব্রিফ না করা, মামলায় গুণগত সাক্ষীদের সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ না করে অধিক সংখ্যক সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা, বর্তমানে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের বিধান অনুসারে জব্দকৃত আলামত উদ্ধার অভিযান, সাক্ষীদের স্বাক্ষর গ্রহণ ইত্যাদি ভিডিওর মাধ্যমে ধারণ এবং ডকুমেন্টের সঙ্গে প্রেরণ না করা, মামলার তদন্ত শেষে চার্ট অব এভিডেন্স দাখিল না করা, সঠিক সময়ে তলব মতে সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন না করা এবং রাষ্ট্রপক্ষ মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার অভাব পরিলক্ষিত হওয়া।
করণীয়
ডিএমপি সূত্র জানায়, মাদক মামলায় জব্দ তালিকায় প্রকৃত সময়, তারিখ ও ঘটনাস্থলের সঙ্গে মিল রেখে এজাহার রুজু নিশ্চিত করতে হবে। এজাহার দায়েরকারী কর্মকর্তা ব্যতীত অন্য কর্মকর্তা দ্বারা মামলার তদন্ত করতে হবে। মাদক মামলার জব্দকৃত আলামত সংখ্যা নয়, ওজনে পরিমাণ করা, আলামতের রঙ ও বহনের প্যাকেট বা মোড়কের বিবরণ, আসামির দেহের বা পোশাকের কোন অংশ হতে জব্দ করা হয়- তার সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে কী পরিমাণ মাদক উদ্ধার করা হলো তা পৃথকভাবে উল্লেখ করতে হবে এবং প্রত্যেক আলামত শনাক্ত করার জন্য আলাদা আলাদা শনাক্তকরণ চিহ্ন দ্বারা মার্ক করতে হবে। ঘটনাস্থলের আশেপাশে অবস্থানকারী আবাসিক ভবনের বাসিন্দা কিংবা কোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্টেশনারি কিংবা যেকোনও স্থায়ী দোকানের মালিকদের মাদক মামলার জব্দ তালিকার সাক্ষী করতে হবে। কোনও অবস্থাতেই ভাসমান দোকানদার কিংবা ভাসমান ব্যক্তিদের জব্দ তালিকার সাক্ষী করা যাবে না।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জব্দ তালিকায় মানিত সাক্ষীদের জবানবন্দি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করে সাক্ষীকে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে শোনাতে হবে। মামলা বিচারকালে কাঠগড়ায় ওঠার পূর্বেই সাক্ষীকে ঘটনা সম্পর্কে জব্দ তালিকার বিষয়ে স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। সাক্ষীদের সংখ্যা নয় বরং গুণগত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলার বিচার করা হয় (সাক্ষ্য আইনের ১৩৪ ধারা)। সুতরাং উদ্ধার মামলার গুণগত সাক্ষী নির্বাচনের মাধ্যমে অধিক সাক্ষী বর্জন করতে হবে। সংশোধিত সাক্ষ্য আইনে ছবি এবং ভিডিওচিত্রের সাক্ষ্যগত মূল্য রয়েছে। সুতরাং জব্দ তালিকা প্রস্তুতকালে অবশ্যই ছবি এবং ভিডিও ধারণ করে মামলার ডকেটে সংযুক্ত করতে হবে। মামলা তদন্ত শেষে চার্ট অব এভিডেন্স অবশ্যই দাখিল করতে হবে। যথাসময়ে সাক্ষীকে আদালতে হাজির ও উপস্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। মামলা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রপক্ষের পিপি ও এপিপিদের সাথে সমন্বয়পূর্বক সাক্ষীর সাক্ষ্য দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে এবং সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে এসে কোনও হয়রানির শিকার হলে পৃথক একটি রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করে প্রতি মাসে পুলিশ কমিশনার বরাবর দাখিল করতে হবে।