১৩ বছর টানা মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সব নিয়ম বানিয়ে ফেলেছেন ‘রাজার নিয়মে’। সেই রাজা আর কেউ নন, ১৩ বছর একই দায়িত্বে থাকা লিয়াকত আলী লাকী। নিয়োগ, কেনাকাটা, যাবতীয় খরচে স্বেচ্ছাচারিতার হাজার প্রমাণেও তাকে টলাতে পারেনি কেউ। দুদক ডেকেছে, মন্ত্রণালয় তদন্ত করতে নেমেছে, কিন্তু সেখানেই শেষ। যখন খুশি চাকরি দিয়েছেন, যাকে খুশি তাকে পোস্টিং, আবার এলাকায় না পাঠিয়ে ঢাকায় রেখেছেন।
সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, অনুসন্ধানের স্বার্থে তথ্য ও রেকর্ডপত্র চেয়ে শিল্পকলার মহাপরিচালককে সোমবার (১৯ আগস্ট) একটি চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
লিয়াকত আলী লাকী শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল। সবশেষ ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ সপ্তমবারের মতো তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। গত বছরের জুনেও ‘সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ’ ব্যানারে লিয়াকত আলী লাকীকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করে সংস্কৃতিকর্মীদের একটি অংশ। তখনও নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন তিনি। সরকার পরিবর্তনের পর লিয়াকত আলী লাকী পদত্যাগপত্র পাঠানোর পর প্রশ্ন উঠেছে, ১৩ বছরে দেশজুড়ে শিল্পকলা একাডেমির যে হাল তিনি বানিয়েছেন, সেখান থেকে এবার কি মুক্তি মিলবে?
থাকার কথা জেলায়, আছেন ডিজির দফতরে
জেলা পর্যায়ে শিল্পকলা একাডেমিতে একজন করে কালচারাল অফিসার থাকার কথা। মহাপরিচালক তার পছন্দের কিছু কালচারাল অফিসারকে জেলায় না পাঠিয়ে ঢাকাতেই রেখেছিলেন। ২০২১ সালে এই কর্মকর্তাদের নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছিল। এখনও সেই অবস্থা বিরাজমান। অন্তত ১০ জন জেলা কালচারাল অফিসার ঢাকায় অবস্থান করছেন। সূত্র বলছে, তারা তাদের নিয়োগ পাওয়া জেলাগুলোতে না যাওয়ায় জেলা পর্যায়ে থাকা কালচারাল অফিসারদের একাধিক জেলার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে।
এখনও ঢাকাতেই থাকবেন নাকি জেলায় যাবেন, জানতে চাইলে কালচারাল অফিসার চাকলাদার মোস্তফা আল মাসউদ বলেন, ‘সেটা অফিসের সিদ্ধান্ত। অফিস যদি মনে করে ঢাকায় রাখা দরকার রাখবে বা যেখানে কাজে লাগবে বললে সেখানে যেতে হবে।’ তাহলে এতদিন এতবার করে বলার পরেও কেন জেলায় ফেরত যাননি কালচারাল অফিসাররা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের যেতে হবে কিনা, নাকি ঢাকায় থাকবো এসব পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ হলো শিল্পকলা একাডেমি। এখানে মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার কোথা থেকে পেলো, সেটা বোধগম্য নয়। এই যুক্তির ভিত্তিতেই আমরা উচ্চ আদালতে রিটের আবেদন করেছিলাম। আইনের ব্যত্যয় যেন না ঘটে, সেই চেষ্টা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের অনেক কর্মকর্তার রুমে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে একটা গোষ্ঠী। চর দখলের মতো এটাও কী করা ন্যায়সঙ্গত কিনা, সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে।’
তদন্ত শেষ হয়েছিল?
২০২১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আর্থিক ও প্রশাসনিক আইনগত বিষয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়। কিন্তু কমিটিকে প্রয়োজনীয় নথি সরবরাহ করা হয়নি। যে কারণে এই কমিটি কাজ শুরুই করতে পারেনি। এ বিষয়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের সঙ্গে তদন্ত কমিটির একাধিকবার চিঠি চালাচালি হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ই-মেইলে কমিটিকে জানান, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা নানান অনুষ্ঠান, সেমিনার ও সভার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখের মধ্যে যাচিত নথি/রেকর্ডপত্র সরবরাহ করা সম্ভব নয়। তার এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ ডিসেম্বর কমিটি তার কাজ সম্পন্ন না করতে পারার বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) শওকত আলী ইতোমধ্যে অবসরে গেছেন।
উল্লেখ্য, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রমসহ পাঁচটি ইস্যুতে তদন্ত শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। তদন্তের জন্য একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। শিল্পকলা একাডেমির আর্থিক ও প্রশাসনিক আইনগত বিষয়ে তদন্তপূর্বক ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন সচিব বরাবর দাখিলের জন্য বলা হয়।
২২৭ কোটি টাকার হিসাব কে দেবে
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ২২৭ কোটি ৭১ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৯ টাকার অনিয়মের সন্ধান পায় হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত অনুসন্ধান করে এই অনিয়মের তথ্য পাওয়া যায়। বিষয়টির জবাব দিতে দুই সপ্তাহ সময় নিলেও মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়কে আর জবাব দেয়নি একাডেমি। মন্ত্রণালয়ের চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স অফিসার বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেন। তাতে অনিয়মের ৭২টি ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। সেটাতে বলা হয়, প্রবিধানমালা উপেক্ষা করে কালচারাল অফিসারদের উপপরিচালক পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করে ২ লাখ ৪৫ হাজার ২৫৯ টাকার দায়িত্ব ভাতা প্রদান করা হয়েছে। একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্রিম বাবদ ১৩ কোটি ৫৬ লাখ ৯৩ হাজার ৭৬৬ টাকা দেওয়া হয়েছে। ড্যান্স অ্যাগেইনস্ট করোনার আওতায় খণ্ডনৃত্য কোরিওগ্রাফি অনুষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ৯৪ লাখ ৬ হাজার ২৪৪ টাকার চেক প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু অনুষ্ঠানটি আর হয়নি। এরকম ৭২ ধরনের অনিয়মের মধ্য দিয়ে প্রায় ২২৭ কোটি টাকার অনিয়ম করা হয়েছে।
শিল্পকলা একাডেমিকে ঢেলে সাজানো এবং যে দুর্নীতির অভিযোগ গত কয়েক বছরে জমা হয়েছে, সেসব নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একাডেমির জন্য নতুন মহাপরিচালক খোঁজা হচ্ছে। নতুন ডিজি জয়েন করার পরে বাকি বিষয়গুলো নির্ধারণ করা যাবে।’ দুর্নীতির অভিযোগগুলো নিয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিল—সেটা প্রতিবেদন দিতে পেরেছিল কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা বেশ আগে, আমার জানা নেই।’