রাস্তায় কথা কাটাকাটির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশেষ সংস্থার পরিচয়ে শাকিল (২৪) নামের এক তরুণকে তুলে নেওয়া অভিযোগ উঠেছে। গত ১৩ জুলাই রাজধানীর মিরপুর-১৩ নম্বর এলাকা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে স্বজনরা দাবি করেছেন। ঘটনার প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও খোঁজ মেলেনি শাকিলের। ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা থানা-পুলিশ থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়েও কোনও জবাব পাচ্ছেন না।
স্বজনরা জানান, শাকিল নিখোঁজের ঘটনায় গত ১৭ জুলাই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাফরুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, শাকিল নিখোঁজের ঘটনা তাদের হাতে নেই। এটা তাদের আয়ত্বের বাইরে।
নিখোঁজ শাকিলের বড় বোন পিংকি আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “গত ১১ জুলাই মিরপুর-১৪ নম্বর মোড়ে (বটতলা) এক রিকশাচালককে মারধর করাকে কেন্দ্র করে ফিরোজ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে শাকিলের ঝগড়া হয়। পরে ফিরোজ নিজেকে ‘ডিজিএফআই’ পরিচয় দেওয়ায় স্থানীয়রা ঘটনার মীমাংসা করিয়ে দেয়। শাকিলও তার কাছে ক্ষমা চায়। এই ঘটনার দুই দিন পর ১৩ জুলাই মিরপুর-১৩ নম্বর পুলিশ স্টাফ কলেজের উত্তর পাশে রাকিন সিটি রূপসার গেটের সামনে থেকে ফিরোজসহ পাঁচ ব্যক্তি শাকিল ও তার বন্ধু অনিককে ধরে নিয়ে যায়। পরে অনিককে মিরপুর-১৪ নম্বরে নামিয়ে দিলেও শাকিলকে নিয়ে যায় তারা। এরপর থেকে আর শাকিলের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”
পিংকি আরও বলেন, ‘ঘটনার পর আমরা একাধিকবার কাফরুল থানায় গিয়েছি। ১৭ জুলাই পুলিশ একটা জিডি নিয়েছে। কিন্তু তারা কোনও সমাধান দিচ্ছে না। পুলিশ বলে এটা তাদের হাতে নাই। পুলিশ শাকিলকে উদ্ধার করতে পারবে না।’
সঙ্গে থাকা অনিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এশার নামাজের পর নাস্তা করে রূপসীর শেষ মাথায় গল্প করছিলাম। হঠাৎ ফিরোজসহ পাঁচ জন লোক এসেই শাকিলের হাতে হ্যান্ডকাফ লাগায়। শাকিলকে একটা অটোতে করে নিয়ে যায়। একজন আমাকে বাইকে করে দ্রুত ১৪ নম্বর মোড়ে নামিয়ে দেয়। তখন আমি শাকিলের কথা জানতে চাইলে বলে, তুই বাসায় যা। শাকিল এক ঘণ্টা পর আসবে। এরপর থেকে আর শাকিলের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।’
এ ঘটনায় সড়কের কয়েকটি সিসি টিভি ফুটেজ আসে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে। সেখানে দেখা যায়, গত ১৩ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর-১৩ নম্বর পুলিশ স্টাফ কলেজের পশ্চিম পাশ দিয়ে ব্যাটারিচালিত একটি নীল রঙয়ের অটোরিকশায় করে শাকিলকে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন ব্যক্তি। অটোরিকশাটি পুলিশ স্টাফ কলেজের সামনে দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে কাফরুল এলাকা দিয়ে চলে যায়। এরপর তাকে আর কোনও সিসি টিভি ফুটেজে শনাক্ত করা যায়নি। অন্যদিকে শাকিলের বন্ধু অনিককে একটি মোটরসাইকেলে করে মিরপুর-১৪ নম্বরের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি।
শাকিলের স্ত্রী জবা আক্তার বলেন, ‘১১ জুলাই ডিজিএফআই-এ কর্মরত দাবি করা ফিরোজের সঙ্গে শাকিলের ঝামেলা হওয়ার পর স্থানীয়রা মীমাংসা করে দিয়েছে। শাকিল তার পা ধরে ক্ষমাও চেয়েছে। এরপরও তাকে ধরে নিয়ে যেতে হবে!’
জবা বলেন, ‘আমরা কয়েকবার পুলিশের কাছে যাওয়ার পর ঘটনার চার দিন বাদে কাফরুল থানা একটা জিডি নিয়েছে। এর মধ্যে ছাত্র-আন্দোলন থাকায় থানায় পুলিশের কোনও দেখা পাইনি। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের বদল হলে আমরা আবার থানা পুলিশের কাছে যাই। ১৩ আগস্ট থানা পুলিশ ফিরোজকে ডেকে এনে কথা বলেছে। তারা আমাদের বাইরে রেখে ফিরোজের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে। এরপর ফিরোজ চলে যায়। তখন পুলিশ আমাদের জানায়, শাকিলের বিষয়টি তাদের হাতে নাই। এটা অনেক ওপরে চলে গেছে। পুলিশ এটা পারবে না।’
শাকিলের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের ভাটিয়া নামা পাড়া। বাবার নাম আংগুর মিয়া। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে শাকিল দ্বিতীয়। এক বছর আগে শাকিল বিয়ে করেন। তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। বর্তমানে মিরপুর-৩ নম্বর ধামাল কোট স্কুলের পশ্চিম পাশে কাশেমের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।
শাকিলের বাবা আংগুর মিয়া বলেন, ‘আপনারা আমার ছেলেকে ফিরাইরা দেন। প্রয়োজনে আমার ছেলেকে নিয়ে গ্রামে চইলা যামু। আপনাগো পা ধইরা বইসা থাকমু। তাও আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরাই দেন। আমি আপনাগো কাছে দুই হাত ধইরা ক্ষমা চাই।’
নিখোঁজের পরিবারের সঙ্গে কাফরুল থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড বাংলা ট্রিবিউনের কাছে আসে। সেখানে শোনা যায়, ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, ‘সে তো (ফিরোজ) আমাকে বলেছে, সে ডিজিএফআই-এর লোক। তাছাড়া সেদিন শাকিলের সঙ্গে মারামারির পর যারা (নেতারা) ঘটনা মীমাংসা করে দিয়েছে তারাও তো সবাইকে চিনে। শাকিলকে যখন ধরে নিয়ে যায় এবং অনিককে যে বাইকের পেছনে নিয়ে নামিয়ে দিয়েছে, তাকেও তো সবাই চেনে। এখন ডিজিএফআই অস্বীকার করছে, ফিরোজ ডিজিএফআইয়ের লোক না। আপনারা ভালো করে ধরেন। সব বের হয়ে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা নিজেরাই আন্দোলন করে সব বের করেন। এছাড়া আমার আর কিছু বলার নাই। আমি ছোট কর্মকর্তা, ঘটনা সম্পর্কে আমাদের ঊর্ধ্বতন সবাইকে বলছি। এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটলে আামদের সাধ্য অনুযায়ী উদ্ধার করে নিয়ে আসি। তবে এটা এমন একটা ঘটনা, আমাদের কিছু করার নাই। এখান থেকে বের করার একটাই উপায় আছে, সেটা হলো আপনারা সমন্বয়কদের সাহায্য নিতে হবে। তারাসহ ফিরোজকে ডাকা হবে, তাকে বলা হবে আপনি শাকিলকে নিয়ে আসেন। প্রয়োজনে আমরা ভিডিও ফুটেজসহ সব প্রমাণ দেবো। আগের দিন ঝামেলা করছেন, পরের দিন তুলে নিয়ে গেছেন। ফিরোজকে ধরলেই সব বের হয়ে আসবে। এছাড়া ভাই আপনি কোনও জায়গায় গিয়ে কোনও সমাধান পাবেন না। আমাদের সিনিয়র অফিসারও একটা কথাই বলছে, তাদের সমন্বয়কদের কাছে পাঠিয়ে দিতে। এরপর আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। আমি একটা কথাই আপনাদের বলছি, যদি ডিজিএফআই না নিতো কবেই উদ্ধার করে ফেলতাম। দেখেন ভাই আমার পরিবার আছে, বাচ্চা-কাচ্চা আছে।’
এ ব্যাপারে ডিএমপি মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, ‘যেকোনও নিখোঁজের ঘটনায় আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে থাকি। এই ঘটনাকেও গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। বিষয়টি ভালোভাবে ক্ষতিয়ে দেখা যায়।’