আজ আমাদের সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বহীন যদি কিছু থেকে থাকে, তা আর কিছু নয়; বরং শৃঙ্খলার প্রতি অবহেলা ও সময়কে অবমূল্যায়ন করা। বাস্তবিক পক্ষে সময় ও শৃঙ্খলার গুরুত্বের প্রতি আমাদের ইতিবাচক অনুভূতি অনেক কমে গেছে। ফলে মুহূর্তকালকে মূল্যায়ন না করার কারণে আমাদের পুরো জীবনটাকেই খুব সহজে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলছি আমরা।
সত্যি কথা হলো- যদি জীবনযাত্রায় আমরা সময়ের মর্যাদা না দেই এবং মূল্যবান সময়কে হেলায়-ফেলায় ও গাফলতির মাধ্যমে অতিবাহিত করি, একই সঙ্গে যদি সময় নষ্ট হয় মন্দ ও অনর্থক কাজে, তাহলে আমাদের সামনে হতাশা ও লজ্জা ছাড়া আর কী অপেক্ষা করছে?
পবিত্র কোরআনে সুরা ফাতিরের ৩৭ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি যে, তখন কেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো? আর তোমাদের কাছে তো সতর্ককারী এসেছিল। কাজেই তোমরা আজাব আস্বাদন করো, আর জালিমদের কোনও সাহায্যকারী নেই।’ এটাই সেই মৌলিক দর্শন যার মাধ্যমে ইসলামে শৃঙ্খলা ও সময়ের গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সময়কে অবহেলায় নষ্ট না করার প্রতি সতর্ক করা হয়েছে। সুরা আসরের মধ্যে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘সময়ের কসম। নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে (কারণ তার সময় (জীবন) ফুরিয়ে যাচ্ছে)।’
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, দু’টি নেয়ামতের ব্যাপারে মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, তা হলো- সুস্থতা ও অবসর। (বুখারি ও সুনানে তিরমিজি) মহান আল্লাহ মানুষকে শারীরিক সুস্থতা ও অবসর সময় উপহার দিয়েছেন। মানুষ মনে করে যে, এগুলো স্থায়ী, কখনও হাতছাড়া হবে না। কিন্তু বাস্তব কথা হলো- তাদের মধ্যে এ চিন্তা শয়তানি ওয়াসওয়াসা ও ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়।
এজন্য মানুষের কর্তব্য হলো- বড় বড় নেয়ামতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া এবং সেগুলোর কদর করা। আর এটা হবে নেয়ামতগুলোর সুন্দর ও সুষম ব্যবহারের মাধ্যমে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে থাকবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞেস না করা হবে- এক, তোমার জীবন কীভাবে অতিবাহিত করেছো? দুই, নিজের ইলমের ওপর কতটুকু আমল করেছো? তিন, সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছো এবং কোথায় খরচ করেছো? এবং চার, নিজের যৌবনকে কোন কাজে ব্যয় করেছো? (তিরমিজি)
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যদি কেয়ামত শুরু হয়ে যায় এবং তোমাদের মধ্যে কারও হাতে খেজুরের ছোট্ট একটি চারাও থাকে এবং সে যদি সক্ষম হয়, তাহলে হিসাব দেওয়ার জন্য দাঁড়ানোর আগে তার জন্য ওই চারাটি রোপণ করা জরুরি। (মুসনাদে আহমাদ) এই হাদিসের ভাষ্য থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) সময়ের প্রতি কতটা গুরুত্ব দিতেন। জীবনসায়াহ্ণেও একটি মুহূর্ত যেন নষ্ট না হয় এবং মুহূর্তটি যেন নেক কাজে ব্যয় হয়- সেই নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ মানবজীবনে গাফলতের অনুপ্রবেশের সুযোগ যাতে না হয়, সেই দিকে গুরুত্বারোপ করেছেন।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা পাঁচটি জিনিসের আগে পাঁচটি জিনিসকে মূল্যায়ন করো। তা হলো- এক, যৌবনকে মূল্যায়ন করো বার্ধক্যের আগে। দুই, সুস্থতাকে মূল্যায়ন করো অসুস্থতা আসার আগে। তিন, সচ্ছলতাকে মূল্যায়ন করো দারিদ্র্য আসার আগে। চার, অবসরকে মূল্যায়ন করো ব্যস্ততা আসার আগে এবং পাঁচ, জীবনকে মূল্যায়ন করো মৃত্যু আসার আগে। (মুস্তাদরাকে হাকেম)।
এই হাদিসের মধ্যে প্রতিটি মুমিন বান্দার জন্য শিক্ষা এই যে, এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অতিবাহিত করতে হবে। এই জীবনকে মৃত্যুর আগে গণিমত মনে করে একথা মাথায় রাখতে হবে যে, কেয়ামতের দিন জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে। আর হিসাব দিতে হবে জনসম্মুখে। এজন্য সময় থাকতেই এর মূল্য দেওয়ার অনুশীলনের সুযোগ এখন থেকেই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করেন। আমীন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।