রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির সামনে থেকে ‘নিখোঁজ’ হয়েছিল ১১ বছরের স্কুলছাত্রী। একদিন পরে নওগাঁ থেকে তাকে উদ্ধার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। শিশুটি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে নানা কটূক্তি শুরু হয়েছিল ফেসবুকে। আর উদ্ধার হওয়ার পরে সেই কটূক্তি বিষোদ্গারের রূপ নিলো। মূলধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার নিখোঁজ হওয়ার কারণ ও উদ্ধারের পরের বক্তব্য প্রচারে মানা হয়নি শিশু আইন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শিশুটি যদি আপনার হতো, তাকে এভাবে সবার সামনে হেয় করার আগে একবার ভাববেন কিনা। তার ভবিষ্যৎ দুর্বিষহ যেন না হয়— সেই চেষ্টা করা সবার উচিত ছিল কিনা।
মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকালে নওগাঁ সদরের মধ্যপাড়া এলাকা থেকে ওই কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকালে টেলিভিশন সাংবাদিক, ইউটিউবের কনটেন্ট ক্রিয়েটররা তাকে ঘিরে ধরে নানা অসংবেদনশীল প্রশ্ন শুরু করেন। যদিও শিশু আইনের ৫৪ ধারায় আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা ও সুরক্ষার কথা বলা আছে। আইন বলছে, আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, বয়স, লিঙ্গ এবং অক্ষমতা ও পরিপক্বতার জন্য কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। শিশুর সঙ্গে কে কোন পরিস্থিতিতে কথা বলতে পারবে—তা উল্লেখ করে আইনে বলা আছে, শিশু বিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক বিশেষ শিশুবান্ধব পরিবেশে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর সাক্ষাৎকার নিতে হবে। তবে সেক্ষেত্রেও শর্ত দেওয়া আছে। সেক্ষেত্রে শিশু যদি মেয়ে হয়, তবে সেই শিশুর মাতা-পিতা অথবা তাদের অবর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ অথবা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারের সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা, যাদের উপস্থিতিতে শিশু সাক্ষাৎকার প্রদানে রাজি থাকে বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তবে তাদের উপস্থিতিতে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা সাক্ষাৎকার নেবেন।
অথচ, মঙ্গলবার নওগাঁ থেকে এই শিশু উদ্ধার হওয়ার পরে গণমাধ্যমের সামনে আনা হয় তাকে এবং মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিশুটির ছবি, ভিডিও ও নেতিবাচক মন্তব্যে ছেয়ে যায়। যেকোনও মন্তব্য করার আগে ভাবুন, শিশুটি যদি আপনার নিজের হতো বা হয়, তাহলে আপনি কী করতেন, কী বলতেন প্রশ্ন তোলেন শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা গওহার নঈম ওয়ারা।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উপস্থাপনের আগে শিশুটির সর্বোচ্চ স্বার্থের (বেস্ট ইন্টারেস্ট) কথা ভাবতে হবে, ভাবতে হবে তার নিরাপত্তা আর ভবিষ্যতের কথা। আমার ভয় হচ্ছে, শিশুটিকে তার স্কুল আর ফেরত নেবে না, অন্য স্কুলের দরজা কি তার জন্য খুলবে?’
১১ বছরের একটি শিশুকে গণমাধ্যমে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আমাদের নৈতিক এবং আইনি কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে উল্লেখ করে শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সেই নৈতিকতা ও বাধ্যবাধকতা এ ঘটনার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি। এমনভাবে শিশুকে কোথাও উপস্থাপন করা যাবে না— যেটি শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থকে—তার পরিচিতি, তার বেড়ে ওঠা, ভবিষ্যৎ, সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে কোনোভাবে হেয় করে। এক্ষেত্রে কী ঘটেছে আমরা দেখেছি। শিশুটির সম্মতিক্রমে কী রকম পরিবেশে তার সাক্ষাৎকার বা মতামত দেবে, সেটি একেবারেই অনুসরণ করা হয়নি। অসংবেদনশীল প্রশ্ন করা হয়েছে। শিশুর বয়স উপযোগী প্রশ্ন করা হয়নি। আইনের সংস্পর্শে আসা একটি শিশুকে কীভাবে উপস্থাপন করতে হবে—তার জন্য গণমাধ্যম নিজে প্রস্তুত হতে পারেনি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ইউটিউব ও অন্যান্য মাধ্যমে যারা ভিউ পাওয়ার উদ্দেশ্যে এটিকে নানাভাবে উপস্থাপন করেছে এবং দিন শেষে মিডিয়া ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে শিশুটিকে যেতে হয়েছে। এটি কাঙ্ক্ষিত নয়। শিশুর বতর্মান তো নয়ই, ভবিষ্যৎও যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব ছিল। সেক্ষেত্রে আমাদের শিশু আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক। আশা করবো সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম আরও বেশি দায়িত্বশীল ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।’